বিমা ও খনি বণ্টনের পর জমি অধিগ্রহণ। প্রথম দুই ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির সীমা বাড়াতে এ সপ্তাহেই অধ্যাদেশ জারি করেছে কেন্দ্র। সংসদের দুর্গম পথে চলতে গিয়ে সংস্কারের রথ বারবার থমকে যাচ্ছে। এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদীর সরকার জমি অধিগ্রহণের আইন সংশোধনেও অর্ডিন্যান্স তথা অধ্যাদেশ জারির পথেই হাঁটতে চাইছে।
মাত্র সাত দিন আগেই কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী চৌধুরি বীরেন্দ্র সিংহ বলেছিলেন, “রাজনৈতিক সর্বসম্মতি গড়ে না ওঠায় এখনই জমি বিল সংশোধন হবে না।” কিন্তু সবুর করতে রাজি নন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিনিয়োগকারী ও শিল্পমহলের প্রত্যাশা পূরণের চাপ রয়েছে তাঁর উপর। রয়েছে প্রতিশ্রুতি পূরণের দায়ও। ১০০ দিনের মধ্যে জমি আইন সংশোধনে বিল পেশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন তিনি। তা সম্ভব হয়নি। এ বার জোড়া অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে তা-ও শিল্প ও বণিকমহলকে এক প্রস্থ বার্তা দেওয়া গিয়েছে। আপাতত সেই পথেই দ্রুত এগোতে চাইছেন মোদী, অরুণ জেটলিরা।
এ ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করার অন্য কারণও রয়েছে। ইউপিএ জমানার শেষ দিকে শতাব্দী-প্রাচীন জমি অধিগ্রহণ আইন বাতিল করে নতুন জমি আইন (জমি অধিগ্রহণের ফলে স্বচ্ছতার সঙ্গে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার ও পুনর্বাসন আইন ২০১৩) পাশ হয়েছিল। ওই আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয় ১ জানুয়ারি ২০১৪ থেকে। নতুন এই আইনে বলা হয়েছে, রেল, পরমাণু প্রকল্প, জাতীয় সড়ক, এসইজেড ইত্যাদি ১৩টি ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের যে আলাদা আইন রয়েছে, তা এক বছরের মধ্যে বিলোপ পাবে। ১ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে চালু হয়ে যাবে অভিন্ন আইন।
কিন্তু মোদী সরকার এখনকার মতো আলাদা-আলাদা অধিগ্রহণ নীতিই চালু রাখতে চান ওই ১৩টি ক্ষেত্রে। গত ২৭ জুন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যের ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী ও সচিবদের বৈঠকে রাজ্যস্তর থেকেও সেই দাবি উঠেছিল। তাই জমি আইন সংশোধনে অর্ডিন্যান্স আনতে হলে ১ জানুয়ারির আগেই তা করতে হবে। এ ব্যাপারে গত আইন মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনার জন্য গত পরশু গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রককে নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়।
সরকার কেন বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার পথে হাঁটছে না?
জেটলিরা মনে করছেন, ওতে সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু হবে না। বিমা বিলে কংগ্রেস-সহ বিরোধী পক্ষের অনেক দলের সমর্থনের আশ্বাস মিলেছিল। কিন্তু সংসদে তাঁরা ওই বিল পাশ হতে দেননি। তা ছাড়া সরকারে আসার ১০০ দিনের মধ্যে জমি বিল পেশের সময়সীমার কথা মাথায় রেখে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরুও করেছিলেন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী। সব রাজ্যের ভূমি রাজস্ব সচিব বা মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সংশোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সচিবলায়ে একটি সুপারিশ পাঠান তিনি। তবে সরকার যে সংশোধন প্রস্তাবগুলি আনতে চাইছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক সর্বসম্মতি হওয়া মুশকিল দেখে থমকে যায় মন্ত্রক। বর্তমান গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী বীরেন্দ্র সিংহ ক’দিন আগে তাই বলেন, “আইন সংশোধনে তাড়াহুড়ো না করে আরও এক বার সর্বদল বৈঠক ডাকার কথা ভাবা হচ্ছে।” কিন্তু জেটলিদের বক্তব্য, বিরোধীরা কখনওই এতে সায় দেবেন না। তাই বৃথা সময় নষ্ট না করে, বিকল্প পথ দেখা হোক।
বর্তমান জমি আইনে কী ধরনের সংশোধন আনতে চাইছে সরকার?
তালিকায় সবার আগে রয়েছে, শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে কৃষক তথা জমির মালিকের সম্মতি নেওয়ার শর্ত শিথিল করা। কারণ, শিল্প মহল তো বটেই দল বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের মতে, এর জন্যই জমি অধিগ্রহণে খামোখা দেরি হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বিগত বাম সরকারেরও মত ছিল এটা। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেনদের বক্তব্য ছিল, রাজ্যে জমির মালিকানা ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত। এক লপ্তে অনেকটা জমি নিতে হলে কৃষকদের সম্মতি পাওয়াটা খুবই সমস্যার।
ইউপিএ জমানায় পাশ হওয়া নয়া জমি আইনে বলা হয়েছে, বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি নিতে হলে অন্তত ৮০ শতাংশ জমি মালিকের সম্মতি নিতেই হবে। এটাই ৬০ বা ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারে সরকার। তা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রকল্পের ক্ষেত্রে সম্মতির শর্ত তুলেই দিতে পারে সরকার।
দুই, জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সামাজিক প্রভাব সমীক্ষার নিয়ম লঘু করা। অধিকাংশ রাজ্যের দাবি, ১০০ একর বা তার কম জমি লাগবে এমন প্রকল্পের ক্ষেত্রে এই সমীক্ষার প্রয়োজনই নেই। মোদী সরকার এই দাবি মেনে নেওয়ার পক্ষে।
তিন, বিলোপ করা হতে পারে জমি আইনে ‘রেট্রোস্পেকটিভ’ ধারা। অতীতে অধিগৃহীত জমির ক্ষেত্রে নতুন হারে পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের দাবি তোলার পথ বন্ধ করতে চায় সরকার।
চার, আপৎকালীন ভিত্তিতে জমি অধিগ্রহণে সংসদের অনুমতি নেওয়ার নিয়মও তুলে দেওয়া হতে পারে।
শিল্পমহল অবশ্য চাইছে আরও একটু বেশি। তাদের দাবি পুনর্বাসনের শর্তও শিথিল করা হোক। কারণ, বর্তমান জমি আইনে যে হারে পুনর্বাসন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তাতে, শিল্প স্থাপনের খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কিন্তু এই বিষয়টি রাজনৈতিক ভাবে স্পর্শকাতর। অতীতে নিতিন গডকড়ী ও এখন চৌধুরি বীরেন্দ্র সিংহ বারবারই বলছেন, কোনও ভাবেই কৃষকদের স্বার্থ লঘু করা হবে না। কারণ, তাঁরা জানেন এটা করা হলেই দেশ জুড়ে কৃষক অসন্তোষে হাওয়া দেবে বিরোধীরা। তবে ঘটনা হল, মুখে মন্ত্রীরা যাই বলুন পুনর্বাসন বাবদ বোঝা কমানোরও রাস্তা খুঁজছে সরকার। যেমন সংশোধন বিলে আপৎকালীন ভিত্তিতে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের মাত্রা কমানোর প্রস্তাব রয়েছে।
তবে জমি আইন সংশোধনের জন্য এখন অর্ডিন্যান্স জারি করলেও ঝক্কি শেষ হবে না। সংসদে পরে তা পাশ করাতেই হবে। এই সংশোধন প্রস্তাব বিমা বিলের মতো নয় যে নৈতিক ভাবে এতে কংগ্রেসের সায় রয়েছে। বরং রাহুল গাঁধী দলীয় বৈঠকে স্পষ্ট করেছেন, জমি বিল সংশোধনে সরকার হাত দিতে গেলেই বাধা দিতে হবে। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ বলেন, “বিজেপি যে কতটা দ্বিচারী স্পষ্ট হয়ে গেল। জমি বিল পাশের সময় বিজেপির সঙ্গে সব স্তরে আলোচনা হয়েছে। বিজেপি যে ধারাগুলি সংশোধন করতে চাইছে, অতীতে সেগুলির জন্য সুষমা স্বরাজরাই পীড়াপীড়ি করেছিলেন।”
শুধু কংগ্রেস নয়, তামাম বিরোধী দল, এমনকী জয়ললিতার এডিএমকে এবং বিজু জনতা দল এ ব্যাপারে কী অবস্থান নেয় সেটাও দেখার। তবে এটা স্পষ্ট, রাজ্যসভায় এই অর্ডিন্যান্স পাশ করানো সহজ হবে না। সে ক্ষেত্রে যৌথ অধিবেশন ডাকার পথে হাঁটতে হতে পারে মোদী সরকারকে।