‘চিত্রকলাশিল্প’ বিষয়ে লিখতে বসে প্রথমেই পাহাড় প্রমাণ প্রশ্নটি পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। কোথাকার চিত্রশিল্পী বা ‘ছবি’ নিয়ে লেখা হবে? স্ব-প্রদেশের, স্বদেশের না বিশ্বের? নাড়ির টানে অথবা গভীর মমত্ববোধ থেকে যদি শুধু বঙ্গদেশের শিল্প প্রসঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হই, তা হলে, ‘একপেশে’ বা ‘প্রাদেশিক’ আখ্যায় ভূষিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। যা আদপেই বাঞ্ছনীয় নয়। অপর পক্ষে, নিখিল বিশ্বের দিগন্ত বিস্তৃত ক্যানভাসের ইতিহাস-ভূগোল তো অকূল পাথার! সেখানে থই পাওয়ার জো নেই এক জীবনে। বরং বিষয়টির প্রস্তাবনা বা নান্দীমুখ হিসেবে সেই ইতিহাস বা প্রাক-ইতিহাস থেকে কিঞ্চিৎ ‘সময়’ তুলে নেওয়া যাক ধার হিসেবে।
জীবজগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষই বোধহয় সর্বপ্রথম নানান অঙ্গভঙ্গি ও ধ্বনির মাধ্যমে মনের ভাবপ্রকাশের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়। যাকে ইংরেজিতে এক কথায় কমিউনিকেশন বলা যায়। গোষ্ঠীবদ্ধ আদি-মানব বাস করত গুহায়। কোথাও কোথাও বিরাট বৃক্ষের তলায়। দলপতি তথা সাঙ্গোপাঙ্গরা দিবসান্তে শিকার করে ফিরে এসে, উত্তেজিত ভঙ্গিতে শিকার-কাহিনি প্রকাশের চেষ্টা করত দলের অন্যদের কাছে। প্রাক্-ইতিহাস মতে সেই সময়েই সম্ভবত প্রথম ‘কমিউনিকেশন’এর উন্নততর মাধ্যম সৃষ্টি হয়। ‘কথা’ বা ‘বুলি’ নয়। ‘ছবি’। ছবি এঁকে এঁকে আপন বীরত্বের সাহসের তথা উত্তেজনাময় ঘটনাবলির গল্প শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত আদিমানব। সুতরাং, গুহাচিত্রে গল্প বা কাহিনি এক দিকে যেমন পৃথিবীতে প্রাথমিক চিত্রশিল্পকলার নিদর্শন বলে গ্রাহ্য, অপর দিকে, তেমনই এই ‘ছবি’ বা ‘ইলাস্ট্রেশন’ই কমিউনিকেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ধরে নিতে কোনও বাধা নেই। এই প্রসঙ্গে লক্ষণীয়, পাশাপাশি আরও একটি বা দুটি শিল্পের প্রাথমিক সূত্রপাত ঘটেছে সমসময়ে। গল্পরচনা ও অভিনয়। সে আবার অন্য পৃথিবী।
স্বদেশের বা ‘মেরা ভারত মহান’এর চিত্রশিল্পী ইত্যাদি বিষয়ে ভাবতে গেলে, দিশেহারা দশা হওয়া স্বাভাবিক। এ যেন, সেই মধ্যযুগের পঞ্চ-ব্যঞ্জন-পরিবৃত ভাতের থালা। না। ঠিক বোঝানো গেল না। বরং বলা যায় ‘লাবড়া’ বা নানাবিধ ব্যঞ্জন সমৃদ্ধ ‘জগা খিচুড়ি’। ভারতীয় কলার বর্তমান চেহারাটিকে একটি মস্ত ক্যানভাস বা পটে কল্পনা করুন। দেখবেন, কেমন যেন বিশৃঙ্খল দৃশ্যাবলি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। মনে হতেই পারে, একটি বহুবর্ণে-রঞ্জিত, বহু রাজ্য বা প্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির তালগোল পাকানো চেহারা। তাবৎ ভারতীয় ভাষাগুলিকে যদি সহসা এক সঙ্গে শুনতে হয় তা হলে যে গোলমাল শ্রুতিগোচর হবে সেই রকমই অনেকটা।
আজকের ভারতীয় শিল্পকলা হয়তো রেগেমেগে পিছন ফিরে দেখতে চাইছে, চোখে যথেষ্ট রাগ, কিড়বিড় করছে দাঁতঅথচ একই সঙ্গে বোকাবোকা হাসি দিয়ে বলতে হচ্ছে“থ্যাঙ্ক ইউ”। যেন, অতীত মুচকি হেসে বলেই ফেলেছে, “খোকা, তোমার ইজেরের বোতাম খোলা”!
ফলে, আমরা, মর্ডান আর্টিস্টরা বোতাম-টোতাম শক্ত করে লাগিয়ে, পশ্চিমকে অথবা দূরতর প্রাচ্যকে নকল করতে তৎপর হই দ্রুত পরিচিতি তথা, অর্থনৈতিক উন্নতি লাভের আশায়। আমাদের কলকাতার সরকারি চারু ও চারুকলা মহাবিদ্যালয়ে একটি বিভাগ ছিল, এখনও আছে ইন্ডিয়ান স্টাইল অফ পেইন্টিং। বিভাগটির প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা-সহকারে প্রণাম জানিয়ে ব্যক্ত করা যায় যে, প্রতি বছর নতুন ছাত্রছাত্রী ভর্তির সময়ে ইনি চাতক পাখির মতো তৃষ্ণার্ত নয়নে চেয়ে থাকেন অন্যান্য বিভাগগুলির দিকে। কারণ, বাকি বিভাগগুলির চাহিদা ভাবী-শিল্পীদের মহলে অনেক বেশি। ব্যবহারিক শিল্প বা অ্যাপলায়েড তথা কমার্সিয়াল আর্ট বিভাগটির চাহিদা তখন তুঙ্গে। পাশ-টাস দিয়ে বের হলে অন্তত বিজ্ঞাপন কোম্পানিগুলিতে চাকরির সমূহ সম্ভাবনা, আশা থাকে।
দু’নম্বরে ঠাঁই ফাইন আর্ট বা চারুকলা বিভাগের। প্রথম প্রথম আর্ট কলেজের বছরগুলিতে আমরা সবাই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বা মাইকেল অ্যাঞ্জেলো। গোগাঁ, ভান গখ, বা পিকাসো। সেই চোখ দিয়ে দেখলেই পরিষ্কার বোধগম্য হবে ফাইন আর্ট ডিপার্টমেন্টের কদর। তাছাড়া দশক দুই-তিন আগেও ভারতীয় চিত্রকলার যথেষ্ট আকর্ষণ ছিল সাগরপারে, পশ্চিমে। যদিচ, বিষয়বস্তু ছিল সীমিত। যথা, সাপুড়ে বা সাপখেলা, দড়ির ভোজবাজি, ডেকোরেটিভ হাতি, বা মুঘল মিনিয়েচার। অথবা যামিনী রায়, নন্দলাল বসু-জাতীয় জলরং ছবি।
তৃতীয় নম্বরে থাকে ভাস্কর্য বিভাগ। ভাবি ভাস্কররাও মনে মনে স্বপ্ন দেখে থাকেন ছাত্রজীবনে রদ্যাঁ, মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো অথবা নিদেন পক্ষে দেশজ দেবীপ্রসাদ-রামকিংকর হওয়ার। ফলে চারে বা তালিকার সর্বশেষে প্রায় তলানি হিসেবে ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে থাকেন ইন্ডিয়ান স্টাইল অফ পেইন্টিং। ক’টি ছাত্র উক্ত তিন বিভাগ থেকে বাতিল হল তারই প্রতীক্ষায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান্তে পুরোদস্তুর শিল্পী হয়ে, ডিগ্রি-ডিপ্লোমা-সার্টিফিকেট বগলদাবা করে তো বের হওয়া গেল সদর্পে। তারপর? আজ প্রাচীন একটি ‘আধুনিক’ গান মনে পড়ে। ‘তার আর পর নেই, নেই কোনও ঠিকানা’। সত্যিই ঘটনা অনেকটা সেই রকম। আলগা হিসেব করলেই চেহারাটি স্পষ্ট হবে। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে খানসাতেক শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা আর্ট স্কুল-কলেজ রয়েছে। সরকারি আর্ট কলেজ, রবীন্দ্রভারতী, আকাদেমি, বিশ্বভারতী, বিড়লা একাডেমি, বর্ধমান আর্ট কলেজ। এছাড়াও মধ্যপ্রদেশের খয়রাগড় আর্ট ইউনিভার্সিটির একটি বড়সড় শাখা কলকাতায় শুরু হয়েছে, শোনা গেল। গোটা বিশ্বের হিসেবে গিয়ে খেই ধরবার সাহস নেই, স্রেফ ভারতবর্ষের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থেকে আন্দাজ করা যাক। ‘মেরা ভারত মহান’এর মাটিতে কমবেশি বিশ-পঁচিশটি রাজ্যের প্রতিটিতে গড়ে যদি নিদেন তিন-চারটিও আর্ট স্কুল-কলেজ বা শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে থাকে, তাহলে বালাই ষাট থেকে শ’খানেক ছবি আঁকা-বিদ্যে শেখার আখড়া স্রেফ এ দেশেই বর্তমান। প্রত্যেকটি বিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর গড়ে অন্তত ৫০ জন কৃতী ছাত্র ডিগ্রি-ডিপ্লোমা-সার্টিফিকেট নিয়ে রীতিমতন পাশ-করা শিল্পী আখ্যার প্রমাণপত্র সমেত বের হন।
এখন কথা হচ্ছে, শিল্প-শিক্ষায়তনগুলি ফি বছর এই যে হাজার হাজার শিল্পীদের বিদ্যে গিলিয়ে উগরে দিচ্ছে বাজারেতাঁরা কোথায়? মানে কে কোথায় কী করছেন বা যাচ্ছেন!
জোছন দস্তিদারকে মনে পড়ে। ওঁর পিতৃদত্ত নাম জ্যোৎস্নাময় ঘোষ দস্তিদারকে ছোট, সহজপাচ্য করা হয়েছিল। আর্ট কলেজের ভাস্কর্য বিভাগের ফাইনাল ইয়ারে ছিলেন, যখন বর্তমান কলমচি ফার্স্ট ইয়ারে নিতান্তই কিশোর। সেই জোছনদার কাছেই পরে একটি ঘটনা বা গল্প শুনেছিলুম ওঁর সহপাঠীর বিষয়ে। যদ্দুর মনে পড়ে তাঁর নাম ছিল বোধহয় সত্যসাধন। তা, এই সত্যবাবুর নাকি বিয়ে হতে হতেও ভেঙে যায়। পাত্র ‘ছবি আঁকে’ শুনেই কন্যেপক্ষ আঁতকে ওঠে, বেঁকে বসেন। তাঁদের মোদ্দা দুশ্চিন্তাই ছিল যে, শিল্পীদের রোজগারপাতি সাধারণতই নেই। চাকরি-টাকরি জুটলেও বড় জোর স্কুলের ড্রইং মাস্টার। আর স্কুল মাস্টারদের চিরন্তন ছবি সেই মধ্যযুগ থেকেও প্রায় একরকম। জীবনযুদ্ধে হা-ক্লান্ত, বিধ্বস্ত সৈনিক। নাকের ওপরে নিকেল ফ্রেমের চশমা, বগলে জীর্ণ ছাতা হেঁটমুণ্ড হেঁটে চলেছেন সেই কবে থেকে। সুতরাং, ‘স্কুলের ড্রইং মাস্টারের মাস মাইনেতে নিজের খোরাকই জোটে না, বিয়ে করলে বউকে খাওয়াবে কি’?
দূরে যাওয়ার দরকার নেই। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। উকিল পিতৃদেবের মতে, আইনের ব্যবসা ভাল। ইচ্ছে ছিল প্রথম পুত্রকে না পারলেও দ্বিতীয়টিকে ল’ পড়াবেন। স্কুল ফাইনালের পর যখন শুনলেন, “আমি ছবি আঁকা শিখব”হতভম্ব চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে দেখলেন। কারণ, গত ষাটের দশকের গোড়ায় মধ্যবয়সি উকিল-ডাক্তাররা সকলেই তেমন ওয়াকিবহাল ছিলেন না এই বিষয়ে। অর্থাৎ, কাজকর্ম বা রোজগারের লাইন কোনটা নেবে? সায়েন্স না কমার্স? বড় হয়ে কী হবে?”
আর যাই হোক, সে সময় পর্যন্ত অন্তত ছবি আঁকাকে কোনও মতেই সিরিয়াস উপার্জনের পথ হিসেবে ধরা হত না। ফলে, ফি বছর শিল্প-বিদ্যাপিঠগুলি যে হাজার হাজার প্রফেশনাল আর্টিস্ট জন্ম দিচ্ছে, তাঁদের হদিশ স্রেফ আর্ট লাইনে পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। ইদানীং যদিচ, শিল্প তথা শিল্পীদের চাহিদা যথেষ্ট বেড়ে গেছে। এককথায় বলতে গেলে, সাধারণের ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে বাজার। তথাপি যাঁরা তলিয়ে ছিলেন, তাঁদের শতকরা নব্বুইজন তলানিতেই রয়ে গেছেন। তবে আমরা সবাই জানি, মানুষের ‘সৃষ্টি’ যে কোনও শিল্পেরই ভালমন্দ বিচার নির্ভর করে ‘সময়ে’র হাতে। ‘সময়ের কষ্টিপাথরে যে ছবি টিকে গেল, সেটিকেই আমরা শুদ্ধ বা ভাল ছবি বলে ধরে নেব। কিন্তু আজ, এই নব্য যুগে ভালমন্দ নির্ভর করে ‘চিৎকারে’র ওপর। স্বকণ্ঠে নয়, পরের মারফত ব্যান্ড বাজিয়ে। অর্থাৎ কিনা প্রচারমাধ্যম। ইংরাজিতে বলে “হাইপ” সৃষ্টি করে। আহা! তা না হলে যে জীবিত অবস্থায় খেতেও পাব না। পরিশ্রম করলুম আমি, না খেতে পেয়ে মারাও গেলুম মরণোত্তর মেডেল কি আমার ফোটোর গলায় ঝোলাবে পরবর্তী প্রজন্ম!’.....
কোনও এক প্রিয়জনের মৃত্যুর পর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত লাইন মনে পড়ে, “মৃত্যুর আগের দিন তাহাকে কি সুন্দর দেখালো”!
কবরে শব হয়ে, শ্মশানে চিতাভস্ম হয়ে তা আর দেখতে যাব না। “ক্রিস্টিজ” বা “সদবি’জ্”এর নিলামে আমার আঁকা একটি ছবি বিক্রি হল কত কোটি টাকায় বা ডলারে? সুতরাং, হে শিল্পী বন্ধুগণ! সামান্য আড়াল নিয়ে নিজের ঢাক নিজেই পেটান। আপন স্বাক্ষরটিকে একটি ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে বাজারে ছাড়ুন, তবেই তো বাড়ি-গাড়ি-এরোপ্লেন আপনার দোরগোড়ায় অহোরাত্র অপেক্ষায় থাকবে! ক্রেমে ক্রেমে দেখবেন পাবলিক আপনার ‘সই’ খাচ্ছে। বাজারে চড়চড় করে চড়ছে আপনার ‘সই’ করা ছবির দাম।
....ভিন্ন রূপে ফিরে যাওয়া সেই অরণ্যে, সেই গুহায়। গুহা-মানবরা বুক চাপড়ে পাথুরে দেওয়ালে ছবি এঁকে নিজেদের অহঙ্কার প্রকাশ করত! এ যুগে আমরা, আসুন, ব্যান্ডপার্টির বাজনা-বাদ্যি পিটিয়ে বাজার জয় করি
এই পৃথিবী, হে ক্রেতা ভাই, “করছো তুমি কি?
এই দ্যাখো না কেমন আমি ছবি এঁকেছি”!