ভাইকে ফিরে পেয়ে। দীপের সঙ্গে দাদা অর্ণব মণ্ডল। রবিবার আইজলে। ছবি: মিজো পুলিশ।
পুলিশ দফতরের সামনে গাড়ি থেকে নেমে পিসতুতো দাদা অর্ণব মণ্ডলের সামনে এসে দাঁড়াল ক্লান্ত, শীর্ণ চেহারাটা। অপহৃত, অসহায় যুবক নন। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ‘ভিআইপি’। তাঁকে ঘিরে ক্যামেরার আলোর ঝলকানি। হলুদ টি-শার্ট পরা ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন অর্ণব। দু’জনেরই চোখের জল বাঁধ মানল না।
বাঁকুড়ার ইন্দাসের বাসিন্দা দীপ মণ্ডল। কর্মসূত্রে গিয়েছিলেন মিজোরামে। গত বছর ২৩ নভেম্বর মামিত জেলা থেকে তাঁকে অপহরণ করে ব্রু জঙ্গিরা। পরে, দীপকে এনএলএফটি জঙ্গিদের হেফাজতে রাখা হয়। চার মাস বাংলাদেশের জঙ্গলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তাঁকে নিয়েই ঘাঁটি বদল করে জঙ্গিরা। মুক্তিপণের জন্য তাঁর পরিবার, নিয়োগকারী সংস্থার উপর চাপ দিতে থাকে। অনেক দর কষাকষির পর শেষে মুক্তি পেলেন এই বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার।
চারদিকে ঘন জঙ্গল নেই। নেই পদে পদে মৃত্যুভয়ের আশঙ্কাও। চার মাস পর নগর-জীবনের হই-হট্টগোলে ফিরে প্রথমে কিছুটা হতবাকই হয়ে পড়েছিলেন বছর তেইশের ওই যুবক। আজ সকালে মিজোরামের আইজলে এসে পৌঁছলেন তিনি। আগের দিন ভারতের মাটিতে পা দেওয়ার পরেই ফোনে কথা হয় বাবা নিখিল মণ্ডল, দাদা অর্ণবের সঙ্গে। দীপকে অর্ণব জানান, তাঁর মুক্তির খবর পেয়ে গ্রামের বাড়িতে, পাড়ায় হোলির মেজাজ। এক গাল হাসলেন জঙ্গি কবল থেকে ফিরে আসা যুবক।
সোমবার দুপুর ২টো ২০ মিনিটের উড়ানে অর্ণববাবু ভাইকে নিয়ে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেবেন। দীপকে স্বাগত জানাতে সোমবার বাসভাড়া করে কলকাতা বিমানবন্দরে যাবেন ইন্দাসের বাসিন্দারা।
গত ২৩ নভেম্বর মিজোরামের মামিত থেকে অপহৃত হয়েছিলেন দীপ। তখন মামিতের পুলিশ সুপার ছিলেন রোডিংলিয়ানা চাওংথু। এখন তিনি সিআইডি-র সুপার। তিনি আজ জানান, জঙ্গিদের সঙ্গে মুক্তিপণ নিয়ে দর কষাকষি চলছিল। সিআইডির স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের অফিসাররা এএসপি এইচ এল থাংজুয়ালার নেতৃত্বে বাংলাদেশের জঙ্গলে ঢোকেন। গত কাল বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ উদোলসিরি গ্রামে দীপকে তাঁদের হাতে তুলে দেয় জঙ্গিরা। তাঁকে নিয়ে হেঁটে মিজোরামের দিকে রওনা দেন পুলিশের ওই অফিসাররা। রাত সাড়ে ১১টায় পৌঁছন মিজোরামের রাজীবনগর গ্রামে। ফের হাঁটা শুরু। মোবাইল ফোনে ‘সিগন্যাল’ ফিরতেই বাবাকে ফোন করেন দীপ। নিখিলবাবুকে বলেন, “ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে বাবা। আমি অফিসারদের সঙ্গে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। ফোনে সিগন্যাল পাচ্ছি না ঠিকঠাক। রবিবার তোমাকে ফোন করব।”
চার ঘণ্টা পর গাড়ি মেলে। আজ ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ দীপকে নিয়ে পশ্চিম ফাইলেং জেলায় পৌঁছয় পুলিশ। সেখানে দীপের ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়। রক্তচাপ কিছুটা বেশি ছিল তাঁর। সকলে আইজল পৌঁছন দুপুর সওয়া তিনটে নাগাদ। ক’মাসে গজিয়ে ওঠা দাড়ি সেখানকার একটি সেলুনে কেটে নেন দীপ।
পুলিশ সূত্রের খবর, অপহরণের পর দীপের ব্যাগ থেকে জিপিএস যন্ত্র, মোবাইল ফোন, পেনড্রাইভ, জামাকাপড়, জুতো-মোজা নিয়ে নিয়েছিল জঙ্গিরা। মুক্তির সময় দীপকে একটি পাজামা, গেঞ্জি ও চটি দেওয়া হয়।
নিখিলবাবুর দাবি, দীপের মুক্তির বিনিময়ে জঙ্গিরা তাঁর ছেলের নিয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ১৫ লক্ষ টাকা নিয়েছে। তবে এই মুক্তিপণের কথা জানতেন না দীপ। তিনি বলেন, “দু’দিন আগে আচমকা ওরা বলল, আমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর কিছুই বলেনি কেউ।”
এ বিষয়ে সরকারি ভাবে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি মিজোরাম পুলিশও। তবে, রাজ্যের এক পুলিশকর্তা জানিয়েছেন, দীপকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারটা রাজ্য পুলিশের পক্ষে লজ্জাজনক। কারণ গত দু’বছরের মধ্যে অপহৃত ছ’জন বনকর্মী, দু’জন গাড়িচালক-সহ অন্যদের মুক্তির জন্য জঙ্গিদের কোনও টাকা দিতে হয়নি। দু’পক্ষের আলোচনাতেই কাজ হয়েছিল। কিন্তু এ বার জঙ্গিরা মুক্তিপণ না-পেয়ে কোনও ভাবেই দীপকে ছাড়তে রাজি হয়নি। মিজোরামের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎ দেব জানান, মুখ্যমন্ত্রী লাল থানহাওলা নিজে দীপের উদ্ধারকাজের তদারকি করেছেন। এ নিয়ে তিনি পুলিশের একটি বিশেষ দলও গড়ে দেন। দিল্লিতে গিয়ে বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে এ নিয়ে কথাও বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
ছেলের চিন্তায় গত চার মাস চোখে ঘুম ছিল না ইন্দাসের মণ্ডল পরিবারে। তাঁরা জানান, গত বছর পুজোর আগেই দিল্লির একটি টেলিকম সংস্থার কলকাতা শাখায় চাকরি পান দীপ। ৫ নভেম্বর অফিসের কাজে গুয়াহাটি যান তিনি। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো
হয় মিজোরামের মামিত জেলায়। পুলিশ জানায়, ২৩ নভেম্বর ডাম্পা ব্যাঘ্র প্রকল্পের চিখা বনশিবিরের কাছে তুইপুইবাড়ির জঙ্গলে একটি মোবাইল টাওয়ার বসানোর কাজ তদারকি করতে গিয়েছিলেন দীপ। ফেরার সময় ডাম্পারেংপুই ও রাজীবনগরের মাঝামাঝি এলাকায় দীপ, তাঁর গাড়ির চালক লাল জামলিয়ান ও অন্য একটি পিক-আপ ভ্যানের চালক সাংলিয়ানথাঙ্গাকে অপহরণ করে ব্রু জঙ্গিরা। সীমান্ত পেরিয়ে তিন জনকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের জন্য ৫ কোটি টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল। এই অপহরণের প্রতিবাদে মিজোরামে আন্দোলন শুরু হলে ২০ জানুয়ারি দুই গাড়িচালককে মুক্তি দেয় জঙ্গিরা। কিন্তু দীপকে ছাড়া হয়নি। তাঁর মুক্তির জন্য এক কোটি টাকা দাবি করা হয়েছিল।
দীপের সঙ্গে দেখা করতে এ দিন আইজলে এসেছিলেন মুক্ত চালক লাল জামলিয়ান। দু’জনেই দু’জনকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন।