মনমোহন সিংহ নেই। এমনকী, সনিয়া গাঁধীও নেই পাশে। একা রাহুল গাঁধী। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি উধাও। তার বদলে সৌম্য ও আত্মবিশ্বাসী মুখ। পাশে লেখা, “রাহুলজির ৯ হাতিয়ার, দূর করেঙ্গে ভ্রষ্টাচার।” আগামিকাল কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত বৈঠকেই রাহুল গাঁধীকে বৃহত্তর দায়িত্ব দেওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হতে চলেছে। তার আগে আজ সাধারণ নির্বাচনের জন্য এমনই পোস্টার ও স্লোগান প্রকাশ করলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। অর্থাৎ দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের বার্তা দিয়ে ভোটযুদ্ধে নয়া ভাবমূর্তি নিয়ে নামতে চলেছেন কংগ্রেসের তরুণ এই নেতা।
দলের তরফে আগামিকালই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে দেওয়া হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও আজ যে দু’টি পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছে তার বার্তাটি বেশ স্পষ্ট। তা হল, রাহুলের নেতৃত্বেই এ বার লোকসভা ভোট লড়বে কংগ্রেস। ফলে এ দু’টি পোস্টারই শেষ নয়, ক্রমশ আরও প্রকাশ পাবে।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, সনিয়া ও রাহুল গাঁধী গত লোকসভা ভোটে তিন জনেরই ছবি ছিল কংগ্রেসের পোস্টারে। এই পর্বে মনমোহন তাঁর বিদায়ের ঘোষণা আগাম করে দিয়েছেন। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার যে আঁচ দিল্লি-সহ কয়েক রাজ্যের বিধানসভা ভোটে মিলেছে, তার পরে আর মনমোহনের মুখকে সামনে রাখারও ঝুঁকি নিতে রাজি নয় দল। জোড়া পোস্টারে সেই বার্তাও স্পষ্ট। একই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট যে সনিয়ার ছত্রছায়া থেকে বার করে এনে রাহুলকে স্বতন্ত্র মুখ হিসেব তুলে ধরতে চায় দল। এই প্রক্রিয়া অনেক আগেই শুরু হয়েছে। শুক্রবার এআইসিসি অধিবেশনের আগে একটু একটু করে পরিবেশ রচনা করতে চাইছেন কংগ্রেস নেতারা। গত কাল সেই জমি তৈরির চেষ্টাই লক্ষ করা গিয়েছে রাহুলের সাক্ষাৎকারে।
যেখানে তিনি জানিয়েছেন, দল চাইলে বড় দায়িত্ব নিতে তিনি প্রস্তুত।
এআইসিসি অধিবেশনের আগে কালকের ওই সাক্ষাৎকার, আজ পোস্টার প্রকাশ পরপর ঘটনাগুলি মেলালে ছবিটা অনেকটাই এক বছর আগের মতো। গত বছর জানুয়ারি মাসে ঠিক এই সময়েই কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডেকে রাহুলকে সহসভাপতি পদে বসানোর ঘোষণা করা হয়েছিল। পর দিন এআইসিসি অধিবেশনে সহসভাপতি হিসেবে প্রথম বক্তৃতা দেন রাহুল।
কংগ্রেস সূত্র বলছে, সম্ভবত আগামিকাল দলের ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত বৈঠকেই রাহুলের বৃহত্তর ভূমিকা নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। তার পর রাতেই ১২ নম্বর তুঘলক লেনে রাহুলের বাসভবনের সামনে এবং সর্বভারতীয় কংগ্রেসের দফতরের সামনে দলীয় কর্মীদের উদযাপন শুরু হয়ে যাবে। পর দিন তালকাটোরা স্টেডিয়ামে বক্তৃতা দেবেন রাহুল। তবে মূল প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। রাহুলকে কি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে দেওয়া হবে? নাকি দলের সভাপতির পদটি ছেলেকে দিয়ে সরে দাঁড়াবেন সনিয়া! নাকি থাকছে পদ ও দায়িত্ব ভাগের নয়া কোনও সমীকরণের চমক! রাহুলকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণার জন্য কংগ্রেসের একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খোলাখুলি সওয়াল করছেন কিছু দিন। অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়ে ভোটে যাওয়া এখন সময়ের দাবি। বর্তমান রাজনীতিতে সেটাই দস্তুর হয়ে উঠেছে।
এর বিরুদ্ধ মতও রয়েছে কংগ্রেসে। এমনকী রাহুল নিজেও কাল সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, কোনও ব্যক্তিকে সামনে রেখে ভোটে যাওয়া কংগ্রেসের রীতি নয়। তা ছাড়া বিজেপি-র সমালোচনা করে রাহুল এ-ও বলেছেন যে, বিজেপি-র কাছে ক্ষমতায় ফেরাটা একটি মাত্র ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা হওয়া উচিত নয়। রাহুল এই মত জানানোর পরে কংগ্রেসের অনেকেই মনে করছেন যে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে রাহুলের নাম ঘোষণার সম্ভাবনা কম। বরং দলীয় সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হতে পারে তাঁর নাম। তাঁদের মতে কংগ্রেস যদি ক্ষমতায় ফিরতে না পারে, তা হলে এক জন পরাস্ত সেনাপতিকে পরবর্তী কালে দলীয় সভাপতি করতে গিয়ে বিতর্ক হবে। সে জন্য আগেভাগেই রাহুলকে কংগ্রেসের সুপ্রিম কম্যান্ডার করে দেওয়া হোক।
তবে রাহুল শিবির বলছে, ওই ঘোষণার পাশাপাশি পরশু কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি যে বক্তৃতা দেবেন সেটাই মুখ্য। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে রাহুল ভোট চাইবেন তা নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু দল তাঁকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে তুলে ধরার পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে তাঁর মত ও নীতিও রাহুলকে দেশের সামনে রাখতে হবে। গত ক’দিন ধরে সেই প্রস্তুতিই চলছে ১২ নম্বর তুঘলক লেনের বাড়িতে। আজ দুপুরে এবং সন্ধেয় দু’দফায় কংগ্রেস ওয়ার রুমে রাহুল শিবিরের নেতারা বৈঠক করেন। ছিলেন প্রিয়ঙ্কা গাঁধীও। সেই সঙ্গে আজ সন্ধেয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রাহুল।
রাহুল-আবাহনের ছবিটা আজ ফুটে ওঠে দলের সদর দফতরে সাংবাদিক বৈঠকেও। জইতাপুর থেকে হরিয়ানা গত ক’দিন ধরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের শিলান্যাস করেছেন মনমোহন। আজ তা নিয়েই কংগ্রেস দফতরে সাংবাদিক বৈঠক করা হয়। কাল থেকে যাবতীয় প্রচার রাহুল-কেন্দ্রিক হয়ে ওঠার আগে মনমোহনের সাফল্য নিয়ে সম্ভবত এই শেষ বার সাংবাদিক বৈঠক করে নিল কংগ্রেস।