পরামর্শদাতা? সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সঙ্গে ইন্দিরা গাঁধী।—ফাইল চিত্র।
দেশে জরুরি অবস্থা জারি করার জন্য আজও প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর সমালোচনা করেন বিজেপি থেকে শুরু করে রাজনীতিতে জয়প্রকাশ নারায়ণের শিষ্যরা। অথচ আজ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড প্রকাশ করে জানালেন, ঘরোয়া অস্থিরতার ওপর লাগাম টানতে সাংবিধানিক এক্তিয়ারের মধ্যে থেকেও যে জরুরি অবস্থা জারি করা যায়, তা ইন্দিরার জানাই ছিল না। তা হলে কে সেই বুদ্ধি দিয়েছিলেন তাঁকে! প্রণববাবু লিখেছেন, তিনিও ছিলেন এক বঙ্গসন্তান। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তাঁর পরামর্শেই দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী।
৭৯ বছর পূর্ণ করে আজ আশিতে এলেন রাষ্ট্রপতি। এবং জন্মদিনেই আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হল তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড। তাতে ছেলেবেলা ও প্রথম জীবনের টুকরো ঘটনার পরপরই নিজের রাজনৈতিক জীবনের সূচনাপর্বের কথা বলেছেন প্রণববাবু। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮০। রাজনৈতিক ভাবে টালমাটাল গুরুত্বপূর্ণ এক দশক। যার কেন্দ্রে রয়েছে জরুরি অবস্থা জারির পর্ব। এই সময়টাতেই ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সখ্য ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাই বইটির নামও দেওয়া হয়েছে, ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গাঁধী ইয়ার্স’।
প্রণববাবু সেখানে লিখেছেন, ইলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে তাঁর নির্বাচন খারিজ হয়ে যাওয়ায় কিছুটা অসহায় বোধ করছিলেন ইন্দিরা। তবে তাঁকে সবচেয়ে আহত করেছিল বিরোধীদের আচরণ। ন্যায্য ভাবে জিতে আসা সরকারকে অগ্রাহ্য করে বিরোধীরা পথে নেমেছিলেন। প্রণববাবুর কথায়, “পরে ইন্দিরা এক সময় আমাকে জানিয়েছিলেন, অভ্যন্তরীণ গোলযোগের ভিত্তিতে জরুরি অবস্থা জারি সংক্রান্ত সংবিধানের ধারা সম্পর্কে তিনি কিছু জানতেনই না। জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল সিদ্ধার্থবাবুর পরামর্শে।”
দুঁদে আইনজীবী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ষাটের দশকের শেষ থেকে ইন্দিরা গাঁধীর কতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, তার উদাহরণও বইয়ে রেখেছেন প্রণব। জানিয়েছেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ বা রদবদলের মতো বহু ঘটনায় ইন্দিরা তখন সিদ্ধার্থবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করতেন, অথবা সিদ্ধার্থবাবু সেই খবর রাখতেন। এমনকী, মন্ত্রিসভায় প্রণববাবুর পদোন্নতি হতে পারে, এই খবর তাঁকে সিদ্ধার্থবাবুই আগাম জানিয়েছিলেন।
আবার সেই সিদ্ধার্থবাবুই পরে কেমন ভোল বদলে ফেলেছিলেন, তা-ও তাঁর বইতে তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রপতি। প্রণববাবুর কথায়, দেশে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর অনেক নেতাই দাবি করতে শুরু করেন, এই কৌশল তাঁদের মস্তিষ্কপ্রসূত। কিন্তু শাহ কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এঁরা প্রায় সকলেই ইন্দিরার ওপরে দায় চাপিয়েছিলেন। সিদ্ধার্থবাবুও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি কমিশনকে বলেছিলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ নিয়ে ইন্দিরা তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েক বার আলোচনা করেন। এমনকী, এ-ও বলেন, দেশের একটা ‘শক ট্রিটমেন্ট’ প্রয়োজন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন সকালে প্রধানমন্ত্রীই তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সে দিন তাঁর হাতে ইন্দিরা কিছু রিপোর্ট তুলে দেন। তাতে লেখা ছিল, দু’তিন মধ্যেই জয়প্রকাশ নারায়ণ নাকি একটি সমান্তরাল সরকার গঠন করবেন। তাতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ সকলকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হবে। এই অবস্থায় কী করণীয়, ইন্দিরা সেটাই জানতে চেয়েছিলেন। সিদ্ধার্থবাবু পরে বলেন, তিনি বিকেলে নিজের মত জানাবেন বলে ফিরে আসেন। তার পর আইনের বইপত্র ঘেঁটে বিকেল সাড়ে চারটে-পাঁচটা নাগাদ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে ইন্দিরাকে বলেন, তিনি চাইলে সংবিধানের ৩৫২ ধারা অনুযায়ী দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন।
সিদ্ধার্থবাবুও যখন জরুরি অবস্থা নিয়ে নিজের দায় এড়িয়ে গেলেন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই কোণঠাসা হয়ে পড়েন ইন্দিরা। প্রণববাবু লিখেছেন, এর পরে এক দিন শাহ কমিশনের সাক্ষ্য দিতে যাওয়ার সময় ইন্দিরা, সিদ্ধার্থবাবু মুখোমুখি। সে দিন ক্রিমসন (উজ্জ্বল লাল) রঙের শাড়ি পরেছিলেন ইন্দিরা। সিদ্ধার্থবাবু তখন বলেন, “তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আজ।” ইন্দিরাজির সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল, “হ্যাঁ! তোমার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও!”
রাষ্ট্রপতির এই আত্মজীবনী প্রকাশ হওয়ার পর কংগ্রেস বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের অনেকেই মনে করছেন, ইন্দিরা গাঁধীর প্রতি তাঁর রাজনৈতিক আনুগত্য যে এখনও কতটা অটুট, তা আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন প্রণব। বইতে প্রণববাবু অবশ্য লিখেছেন, এটা ঠিক যে জরুরি অবস্থা জারির পর জনজীবনে শৃঙ্খলা এসেছিল, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হয়েছিল, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা গিয়েছিল, দেশে জরুরি অবস্থা জারির করার পর কালোবাজারিদের ওপর লাগাম টানা সম্ভব হয়েছিল। তবে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়তো এড়ানোও যেত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবর রহমানের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ, ইন্দিরা গাঁধী ভূমিকার প্রসঙ্গও এই খণ্ডে উল্লেখ করেছেন প্রণববাবু।
জানা গিয়েছে, তাঁর আত্মজীবনীর পরবর্তী খণ্ডে ১৯৮০ সাল থেকে ’৯৮ সাল পর্যন্ত সময়ের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরবেন প্রণববাবু। সেই বইটিতে রাজীব গাঁধীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার হওয়ার ঘটনা থেকে শুরু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ছাড়ার প্রসঙ্গও থাকবে। তার পর ৯৮ থেকে ২০১২ সাল তথা রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়া পর্যন্ত ঘটনা পরম্পরা উঠে আসবে তাঁর আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ডে।