অসমে জঙ্গি হামলার প্রতিবাদে রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, সুজন চক্রবর্তী, বিকাশ ভট্টাচার্য এবং শুভঙ্কর চক্রবর্তী। কান্তিবাবু জানিয়েছেন, রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী এক হাজার কম্বল পাঠিয়েছে অসমে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
নাশকতা হয়ে গিয়েছে। এখন সেই নাশকতা নিয়ে চাপান-উতোর আর শরণার্থীদের নিয়ে রাজনীতিতেই উত্তপ্ত অসম। শরণার্থীর স্রোত এসেছে পশ্চিমবঙ্গে। তাঁদের প্রয়োজনে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী ভাবে বসবাসের আশ্বাস দিয়ে সেই রাজনীতির শরিক হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু আজ অসম সরকার স্পষ্ট জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের কুমারগ্রামে থাকা শরণার্থীদের অসমে ফেরাতে তারা বদ্ধপরিকর।
অসমে এনডিএফবি জঙ্গিদের সাম্প্রতিক হামলার জেরে শরণার্থীর ঢল নেমেছে পশ্চিমবঙ্গে। আলিপুরদুয়ারের অতিরিক্ত জেলাশাসক দেবীপ্রসাদ করণম জানিয়েছেন, রবিবার নতুন করে অসমের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আরও ১০১ জন শরণার্থী কুমারগ্রামে এসেছেন। এই নিয়ে শরণার্থী শিবিরে মোট বাসিন্দার সংখ্যা দাঁড়াল ১৩০৭। এর মধ্যে চ্যাংমারিতে ৪৬৬, হেমাগুড়িতে ১১১ এবং বালাপাড়া ৪৫৫ এবং পূর্ব শালবাড়ি শিবিরে ২৭৫ জন শরণার্থী রয়েছেন।
গত কাল আলিপুরদুয়ার জেলার কুমারগ্রামে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে মমতা জানান, যাঁরা অসমে ফিরতে চান না তাঁরা এই রাজ্যে পাকাপাকি ভাবে থাকতে চাইলে সেটা কী ভাবে করা যায় তাও দেখা হবে।
শরণাথর্ীর্দের জন্য জমি খোঁজার নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা। এই বিষয়ে কোনও প্রশাসনিক কর্তা সরকারি ভাবে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। আলিপুরদুয়ারের অতিরিক্ত জেলাশাসক দেবীপ্রসাদ করণম বলেন, “এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারছি না।” কুমারগ্রামের বিডিও শিলাদিত্য চক্রবর্তী বলেন, “জেলা থেকে যা নির্দেশ পাব, সে ভাবে কাজ করা হবে। এ বিষয়ে কোনও নির্দেশ আসেনি।” কিন্তু জেলারই এক পদস্থ কর্তার কথায়, “আজ থেকেই যে জমি খুঁজতে হবে, এমন কোনও নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রী দেননি। আপাতত মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই শরণার্থীদের যাতে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা নিয়ে কোনও সমস্যা না হয় তার বন্দোবস্ত চলছে। সে সব মিটে গেলে জমি খোঁজার কাজও শুরু হবে।”
প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, শরণার্থীরা অনেকেই ভয়ে নিজেদের গ্রামে আর ফিরতে চাইছেন না। সে ক্ষেত্রে তাঁরা থেকে গেলে যাতে সমস্যা না হয় তার জন্য মুখ্যমন্ত্রী জমি দেখে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। জেলা প্রশাসনের দাবি, আলিপুরদুয়ার, কুমারগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকায় সরকারি জমি রয়েছে। সে কারণে জমি খুঁজে বের করতে কোনও সমস্যাই হবে না। তবে সমস্যা হতে পারে সেই জমির ‘দখল’ নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই খালি পড়ে থাকা সরকারি জমিতে ইতিমধ্যেই দখলদার বসে রয়েছে। পুরনো দখলদার সরিয়ে নতুন করে শরণার্থীদের বসাতে চাইলে আইনশৃঙ্খলার সমস্যাও হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রশাসনের একাংশের।
কিন্তু আজ অসমের স্বরাষ্ট্র কমিশনার ও সচিব প্রতীক হাজেলা বলেন, “কুমারগ্রামে চলে যাওয়া মানুষকে আমরা অবশ্যই অসমে ফেরাব। সে জন্য পদক্ষেপ করা হচ্ছে।” রাজ্যের পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
চলতি বছরের গোড়ায় অসমে গোষ্ঠী সংঘর্ষের ফলে আসা শরণার্থীদেরও রাজ্যে যত দিন খুশি থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মমতা। তাঁদের অনেকে থেকেও যান। তিনি ফের সেই সম্ভাবনা উস্কে দেওয়ায় প্রশাসন ও কুমারগ্রাম লাগোয়া কয়েকটি পঞ্চায়েতের কর্তারা উদ্বিগ্ন।
কিন্তু কেন বার বার শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী ভাবে থাকার এই ডাক?
বিরোধীদের মতে, রাজ্যের নিজস্ব সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া নিয়ে মুখ খুলেছে শাসক দল। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গ কোনও ধর্মশালা নয়। যে আদিবাসীরা অত্যাচারিত হয়ে আসছেন, নিঃসন্দেহে মানবিক ভাবে তাঁদের দেখাশোনা করা উচিত। কিন্তু স্থায়ী বাসস্থানের জন্য জমি খোঁজা কোনও সমাধান হতে পারে না।” তাঁর কথায়, “এ রাজ্যে এমনিতেই জমির উপরে মানুষের চাপ আছে। রাজ্য সরকার কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র দূর করতে ব্যর্থ। সেই অবস্থায় শরণার্থীদের স্থায়ী বাসস্থানের জন্য জমি খোঁজা পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থবিরোধী। রাজ্যের নিজস্ব সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই এ সব করা হচ্ছে।”
তৃণমূলের আলিপুরদুয়ার জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তীর অবশ্য দাবি, মানবিক কারণেই এই পদক্ষেপ করেছেন মমতা। তাঁর কথায়, “প্রাণভয়ে এ রাজ্যে আশ্রয় নেওয়া অসমের শরণার্থীদের পাশে থাকাটাই বেশি জরুরি। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও রাজনীতি ভুলে মানবিক কারণে সকলকে ওঁদের পাশে থাকার আর্জি জানিয়েছেন।” সৌরভবাবুর বক্তব্য, “যাঁরা আতঙ্কে ফিরতে চাইছেন না তাঁদের তো তাড়িয়ে দেওয়া যায় না। মুখ্যমন্ত্রী তাই জমি দেখে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ সেটিকে একশ্রেণির সংবাদ মাধ্যম এবং বিরোধীরা অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করছেন।”
তবে অসম সরকার শরণার্থীদের ঘরে ফেরানোর বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী। স্বরাষ্ট্র কমিশনার ও সচিব হাজেলা জানিয়েছেন, ওদালগুড়ির ত্রাণশিবির থেকে বেশ কিছু পরিবার ঘরেও ফিরেছেন। শিবিরগুলিতে ওষুধ পাঠাবার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ২০ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। জরুরি ওষুধ কেনার জন্য কেন্দ্রের কাছে ১৯ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা চেয়েছে অসম। শিবিরগুলির জন্য পর্যাপ্ত চাল, ডাল, নুন, তেল মজুত রয়েছে বলে দাবি অসম প্রশাসনের। প্রতি জেলায় অতিরিক্ত চিকিৎসক ও অ্যাম্বুল্যান্সও পাঠিয়েছে তারা।
তবে এখনও যে অনেক কিছুই করা বাকি তাও মানছে তরুণ গগৈ সরকার। আজ কোকরাঝাড়ে ত্রাণ শিবির পরিদর্শনে যান রাজ্যের তিন মন্ত্রী। কচুগাঁও শিবিরে দাঁড়িয়ে তাঁরা স্বীকার করে নেন, অনেক সমস্যা রয়েছে। রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন রুণুমি গগৈ ও অন্য শিশু অধিকারকর্মীরা কোকরাঝাড়ের ত্রাণ শিবির ঘুরে দেখেন।
কমিশনের মতে, শীতের মধ্যে যে ত্রাণ আসছে তা পর্যাপ্ত নয়। বিশেষ করে শিশুরা কষ্টে রয়েছে। শৌচ, পানীয় জলের ব্যবস্থাও ভাল নয়। শিশুদের মন থেকে আতঙ্ক কাটানোর প্রয়োজন রয়েছে। পরে ওই শিবিরেই জেঠা মুর্মু নামে এক শরণার্থী মারা গিয়েছেন। জঙ্গি হামলায় ঘরছাড়া হয়েও রাজনীতির হাত থেকে রেহাই নেই শরণার্থীদের।
আটক ৩ জঙ্গি
অসমে গণহত্যার পরে জঙ্গি-বিরোধী অভিযানের জেরে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়ল তিন এনডিএফবি জঙ্গি। সেনা সূত্রে খবর, উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে সেনার হাতে আটক হয় তারা। ওই জঙ্গিদের অসম পুুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় অসমে নতুন হিংসা না হলেও ত্রাণশিবিরে আরও ৭৫ হাজার মানুষ আসায় উদ্বিগ্ন প্রশাসন। গুজব ছড়িয়ে মানুষকে ঘরছাড়া করা হচ্ছে কি না, তা দেখছে পুলিশ।