বাচ্চা মেয়েটির গায়ে একটি হাতকাটা জ্যাকেট। সেই জ্যাকেটে আটকানো আইইডি। নায়কোচিত শৌর্যেই শিশুটিকে বাঁচালেন শাহরুখ খান। আব্বাস-মাস্তানের ‘বাদশা’ ছবিতে। শেষ পর্যন্ত ওই ‘বম্ব ভেস্ট’ বিস্ফোরণে মারা গেল দুষ্কৃতীরাই।
সেলুলয়েডের পর্দাকে হার মানিয়ে ‘বম্ব ভেস্ট’-এর বদলে বাস্তবে হাজির ‘জ্যাকেট-বোমা’। মানববোমারই রকমফের। দেখলে মনে হবে, নেহাতই সাদামাঠা ফুলহাতা জ্যাকেট। সাদা চোখে তো নয়ই, হরেক রকম সন্ধানী যন্ত্র দিয়ে সামনে-পিছনে-ভিতরে পরীক্ষা চালিয়েও অনেক সময়ে চট করে ধরা যায় না সেই পরিধানের কালান্তক রূপ। আসলে অবয়বটা নিতান্তই পোশাকি। আস্ত জ্যাকেটটাই বোমা বা ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি)।
গত মার্চে আফগানিস্তানের কন্দহরের ভারতীয় দূতাবাসে এক জঙ্গি হামলা চালাতে গিয়েছিল এই ধরনের জ্যাকেট-বোমা গায়ে চড়িয়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী-সহ ভিআইপি-দের উপরে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে জঙ্গিরা জ্যাকেট-বোমার মতো মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারে বলে সম্প্রতি সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
সোমবার ভারতের পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। পূর্বসূরিদের তুলনায় তাঁর জন্য অনেক বেশি আঁটোসাঁটো সুরক্ষার বন্দোবস্ত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। অন্তত হাফডজন জঙ্গি সংগঠনের খতম-তালিকায় আছেন মোদী। এই অবস্থায় মোদী সাত নম্বর রেসকোর্সের ঠিকানা বা সাউথ ব্লকে যাওয়ার মুখেই রাজ্যে রাজ্যে পাঠানো সতর্কবার্তায় জ্যাকেট-বোমার বিপদের কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র যুগ্ম অধিকর্তা মনোজকুমার লাল।
বম্ব ভেস্টের সঙ্গে জ্যাকেট-বোমার পার্থক্যটাও ব্যাখ্যা করে দিয়েছে আইবি। বলিউডের ছবি এবং বিভিন্ন টেলি-ধারাবাহিকে আকছার দেখা যায়, অপহরণকারীরা অপহৃতের গায়ে পরিয়ে দিচ্ছে ‘বম্ব ভেস্ট’। যাতে অপহৃত পালাতে ভয় পায় কিংবা অন্য কেউ অপহৃতকে উদ্ধারের ঝুঁকি নিতে না-পারে। এ ক্ষেত্রে ভেস্টের ভিতর দিকে বা উপরে আইইডি আটকানো থাকে। চাইলে সাবধানতার সঙ্গে দক্ষ হাতে খুলেও নেওয়া যায় সেটা। গোপনীয়তার ব্যাপার তেমন নেই।
কিন্তু জ্যাকেট-বোমা আদৌ তা নয়। আইবি জানাচ্ছে, এখানে একটি ভেস্টের ভিতর দিকে আইইডি নিছক আটকানো থাকে না। বরং আইইডি এ ক্ষেত্রে জ্যাকেটেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
কাপড়ের উপরে আইইডি রেখে রঙিন সুতো দিয়ে লম্বালম্বি সেলাই করে অন্য কাপড় দিয়ে এমন ভাবে ঢেকে দেওয়া হয়, যাতে বাইরে থেকে দেখে সন্দেহ করার কোনও উপায় থাকে না। সামনে-পিছনে জ্যাকেটের উপরের অংশে ডিটোনেটর থাকে দু’টি স্তরে। জ্যাকেটের বাঁ দিকের পকেটে থাকে ডটপেনের মতো একটি ‘কলম’। সাদা চোখে কলম মনে হলেও ডটপেনের রিফিল বার করার মতো তার উপরের অংশটি টিপেই ঘটানো হয় বিস্ফোরণ। প্লাস্টিক ডটপেনের খোল দিয়েই বিস্ফোরণ ঘটানোর ওই ‘ইনিশিয়েটর’ বানানো হয়, জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা।
মেটাল ডিটেক্টর বা স্ক্যানারে এর উপস্থিতি ধরা পড়ে না কেন?
গোয়েন্দারা জানান, জ্যাকেট-বোমায় ধাতব উপাদান এত কম থাকে যে, মেটাল ডিটেক্টরের শ্যেনচক্ষু এড়াতে সমস্যা হয় না। আবার সাধারণ জ্যাকেটের মতো চেন ও বোতাম থাকে বলে এক্স-রে স্ক্যানারও চট করে এর বিপদ চিহ্নিত করতে পারে না। জ্যাকেট-বোমা এক থেকে ১৫ কিলোগ্রাম আইইডি বহন করতে পারে। জ্যাকেট-বোমার আইইডি-তে বিস্ফোরক হিসেবে সাধারণ ভাবে ট্রাইনাইট্রোটলুইন (টিএনটি), প্লাস্টিক বিস্ফোরক এবং ট্রায়াসেটোন ট্রাইপেরক্সাইড (টিএটিপি) ব্যবহার করা হয়, জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা।
এই ধরনের জ্যাকেট-বোমা পরেই এক জঙ্গি ১৩ মার্চ কন্দহরের ভারতীয় দূতাবাসে হামলা চালাতে গিয়েছিল। দূতাবাসের মূল ফটক পেরোনোর আগেই বিপদ আঁচ করে আফগান ন্যাশনাল পুলিশ তাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। “এ বছর কন্দহরের ঘটনার পর থেকেই জ্যাকেট-বোমার বিষয়টি আমাদের উদ্বেগে রেখেছে,” বললেন আইবি-র এক কর্তা।
শুক্রবার ফের আফগানিস্তানের হেরাটের ভারতীয় দূতাবাসে হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা। মোদীকে বার্তা দেওয়াই ওই হানার উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। আইবি-র বক্তব্য, মোদী ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন ও লস্কর-ই-তইবার খতম-তালিকায় তো আছেনই। আছেন তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান এবং আল কায়দার নিশানাতেও। তাই এখন জ্যাকেট-বোমার মতো ছদ্মবেশী মারণাস্ত্র সম্পর্কে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।