পাশে আছি। কয়লা-কাণ্ডে মনমোহন সিংহ সমন পাওয়ার পরের দিন কংগ্রেসের সদর দফতর থেকে মিছিল করে তাঁর বাড়িতে গেলেন সনিয়া গাঁধী। সঙ্গে ছিলেন দলের শতাধিক নেতা। ছবি: পিটিআই।
কেউ বলছেন, ১৩০ বছরের প্রাচীন দলটির ইতিহাসে নজিরবিহীন এক ঘটনা। আবার কেউ মনে করছেন, রাজনীতি অনেক সময়ে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো কিছু মুহূর্ত উপহার দেয়। মনমোহন সিংহের প্রতি অটুট আস্থার বার্তা দিতে আজ সম্ভবত তেমনই এক মুহূর্ত সৃষ্টি করলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। যখন বিনা নোটিসে শতাধিক কংগ্রেস নেতাকে নিয়ে দলীয় দফতর থেকে মিছিল করে তিনি পৌঁছে গেলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে। যা দেখে আপ্লুত মনমোহন বললেন, তিনি লড়াই চালিয়ে যাবেন।
কংগ্রেস দফতর থেকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান বাসভবনের দূরত্ব মাপা হলে দেখা যাবে, বড়জোর ধর্মতলায় কে সি দাসের দোকান থেকে রাজভবনের গেট অবধি পথ। কয়েক মিনিটের মিছিল। কিন্তু গোটাটাই যত্ন করে ভিডিও তুলে রাখার মতো। কংগ্রেসের থিঙ্কট্যাঙ্ক থেকে এমন চিত্রনাট্য শেষ কবে বেরিয়েছে?
তাবড় কংগ্রেস নেতার কাছেও আজকের এই হঠাৎ-মিছিল সম্পর্কে আগাম কোনও বার্তা ছিল না! কয়লা-দুর্নীতি মামলায় ‘অভিযুক্ত’ হিসেবে মনমোহনকে আদালতের সমন পাঠানো ঘিরে দিনভর তোলপাড়ের পর গত কাল তখন প্রায় মাঝরাত। এই সময়েই পরপর ফোন পেতে শুরু করেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ও সাংসদরা। এক লাইনের নির্দেশ রাত পোহালেই সকাল সাড়ে ৯টায় দলীয় সদর দফতরে বৈঠক। সেই মতো আজ নির্ধারিত সময়ে নয়াদিল্লির ২৪ আকবর রোডে ভিড় জমান ছোট-বড় শতাধিক নেতা। গুলাম নবি আজাদ, মতিলাল ভোরা, আনন্দ শর্মা, এ কে অ্যান্টনি, অম্বিকা সোনি কে নেই!
এই জটলার মাঝেই হঠাৎ আবির্ভাব সভানেত্রীর। পৌঁছনো মাত্রই সতীর্থদের উদ্দেশে তাঁর ছোট্ট নির্দেশ, “চলুন আমার সঙ্গে।” বলেই হনহন করে গেটের দিকে হাঁটা দেন সনিয়া। প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েও দ্রুত নেত্রীর সঙ্গে পা মেলান নেতারা।
কংগ্রেস দফতর থেকে বেরিয়ে ডান দিকে আন্দাজ পঞ্চাশ গজ এগোলে একটা ‘গোল চক্কর’। সে দিকেই এগিয়ে যান সনিয়া। তাঁর হাঁটার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে প্রৌঢ় অনেক নেতারই তখন হাঁফ ধরার উপক্রম। অথচ গত কয়েক বছর ধরে সনিয়াও তো কমবেশি অসুস্থ। গত পরশুই জমি বিল নিয়ে ভোটাভুটির সময়ে সংসদে থাকতে পারেননি। অথচ আজ সত্তর ছুঁইছুঁই নেত্রীর চোখেমুখে আগ্রাসন।
মিছিল এগোয়। গোল চক্কর পেরিয়ে কোনাকুনি উল্টো দিকে তিন নম্বর মতিলাল নেহরু মার্গের বাংলোটাই এখন মনমোহনের ঠিকানা। সম্ভবত আগেই খবর পেয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। সনিয়া যখন ফটক ঠেলে ঢুকছেন, মনমোহন সস্ত্রীক দাঁড়িয়ে গাড়িবারান্দায়। হাসিমুখে নমস্কার বিনিময় করলেন সনিয়ার সঙ্গে। কিছু পরে বললেন, “দলের এই সমর্থন দেখে আমি মুগ্ধ। লড়াই চালিয়ে যাব।” সনিয়াও সাংবাদিকদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “ওঁর প্রতি অগাধ সমর্থন ও আস্থা রয়েছে। শুধু আইনি পথে নয়, সব রকম ভাবে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর পাশে থাকবে কংগ্রেস।”
বস্তুত, সেই প্রস্তুতি আজ শুরুও করে দিয়েছেন তিনি। দলীয় সূত্রে খবর, মিছিলের পর মনমোহনের বিরুদ্ধে অভিযোগের আইনি মোকাবিলার ব্যাপারে আজ পৃথক বৈঠক করেছেন সনিয়া। দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সেই আলোচনায় স্থির হয়, মনমোহনের হয়ে আদালতে সওয়াল করবেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী তথা বিশিষ্ট আইনজীবী কপিল সিব্বল এবং কে টি এস তুলসী।
তবে সেই সওয়াল-জবাবের দেরি আছে। বরং যে প্রশ্নটা উঠছে, কেন এই ছকভাঙা মিছিলে সনিয়া?
গাঁধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ নেতারা নিজেদের মতো করে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে, এক দিন ‘অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিয়ে’ প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি সনিয়া। মনমোহনের ওপরে আস্থা রেখেছিলেন। তাঁর সেই সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না, তা বোঝানোর দায় এখন সনিয়ারই। তা ছাড়া, মনমোহনের ব্যক্তিগত সততা প্রশ্নাতীত। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিনি সমাদৃত। সেটাও সনিয়াকে শক্তি জোগাচ্ছে।
আরও একটা বিষয় রয়েছে। মনমোহনকে সমন পাঠিয়েছে আদালত। এক দিকে আদালতের নির্দেশের বিরুদ্ধে মুখ খোলা সম্ভব নয়। অন্য দিকে, মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ তোলাটাও কঠিন। গাঁধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ নেতাদের মতে, প্রতিবাদ মিছিল করে সনিয়া আদপে সেই অভিযোগই তুললেন, কিন্তু পরোক্ষে। বোঝাতে চাইলেন, রাজ্যসভায় শাসক পক্ষের ক্রমাগত নাস্তানাবুদ হওয়া থেকে দেশবাসীর নজর ঘোরাতেই মনমোহনকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। কিন্তু যে পরিস্থিতিই আসুক, দল তাঁর পাশে আছে। সেই সঙ্গে একের পর এক ভোটে হারতে হারতে হতোদ্যম হয়ে পড়া দলীয় কর্মীদেরও আজ চাঙ্গা করতে চাইলেন সভানেত্রী।
তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সনিয়ার আগ্রাসনের কারণ শুধু এটুকুই হয়তো নয়। তা আরও গভীর। নরসিংহ রাওয়ের সঙ্গে সনিয়ার মতান্তর ছিল। তাই তাঁর পাশে এ ভাবে কখনও দাঁড়ায়নি কংগ্রেস। মনমোহনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। তাঁর জমানায় বারবার অভিযোগ উঠেছে যে, সনিয়া ক্ষমতার একটি মেরু ধরে রেখেছেন বলেই মনমোহন সরকার নীতিপঙ্গুতার শিকার। একের পর এক দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। অথচ কর্তৃত্বের অভাবে তা ঠেকাতে পারেননি মনমোহন। তাই বিশেষজ্ঞদের মত, নিজের তাগিদেই মনমোহনের পাশে দাঁড়াচ্ছেন সনিয়া। অতীতে বিপদের সময় মনমোহন বহু বার নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে দল ও জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতাকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। সনিয়া আজ সেই রাস্তায় পাঁচিল তুলে দিলেন।
বিজেপি অবশ্য আজও কটাক্ষ করতে ছাড়েনি। দলের মুখপাত্র শাহনওয়াজ হুসেন বলেন, “আইন আইনের পথে চলছে। কিন্তু তা নিয়েও রাজনীতি করছে কংগ্রেস।” তবে বিজেপি জানে, মনমোহনকে শহিদ করে তাদের রাজনৈতিক লাভ নেই। বরং তদন্ত দশ জনপথ পর্যন্ত গড়ালেই তাদের ফায়দা।
একটা বিষয়ে সব পক্ষই একমত। তা হল দশ জনপথের বাইরের কোনও কংগ্রেস নেতার প্রতি গাঁধী পরিবারের এই মাত্রার আস্থাজ্ঞাপন সত্যিই ‘বিরল’। সনিয়া নিজের তাগিদে দশ জনপথ থেকে বেরিয়ে কোনও কর্মসূচি বা বৈঠকে যাচ্ছেন, এমন উদাহরণ খুব বেশি নেই। ধর্মনিরপেক্ষ জোট গড়ার লক্ষ্যে ২০০৪ সালে প্রতিবেশী রামবিলাস পাসোয়ানের বাড়িতে হেঁটেই চা খেতে গিয়েছিলেন তিনি। সে-ও ছিল আকস্মিক। ঠিক যেমন আজকের চিত্রনাট্য।
যে চিত্রনাট্যে একমাত্র তাল কেটেছে রাহুল গাঁধীর অনুপস্থিতি। যা নিয়ে কংগ্রেসের এক নেতার মত, ছেলেকে আজ আরও চাপে ফেলেন দিলেন মা। কারণ, সনিয়ার এই আগ্রাসী ছবির তুলনায় এর পর রাহুলকে আরও ছোট দেখাবে।
হয়তো বা এর চেয়েও বড় কোনও বার্তা দিল আজকের মিছিল— ‘পারলে সনিয়াই পারেন’!