গেরুয়া-সবুজ কুর্তা আর বুকে তেরঙ্গা নিয়ে সকাল বেলায় বাড়ি থেকে বেরোতেই গাড়ি আটকালেন জনা দশেক শিবসৈনিক। গাড়ি থেকে নামতেই মুখে কালি লেপে দিলেন সুধীন্দ্র কুলকার্নির।
সেই সুধীন্দ্র কুলকার্নি, যিনি এক সময় অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আডবাণীর সহযোগী হিসেবেও কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী জমানায় তাঁর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় বিজেপির। এখন তিনি ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান। এবং তাঁর উদ্যোগেই আজ মুম্বইতে নিজের বই প্রকাশ করতে এসেছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি। ক’দিন আগেই মহারাষ্ট্রে পাক গায়ক গুলাম আলির অনুষ্ঠান বানচাল করেছে বিজেপির শরিক শিবসেনা। আর এ বারে তাদের মত, পাক সন্ত্রাসবাদের হামলা ভুলে কুলকার্নির মত ‘পাক-এজেন্ট’-এর মুখে কালি লেপে তারা গণতান্ত্রিক ও অহিংসার পথই নিয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কার মুখে কালি পড়ল?
শুধু কি কুলকার্নি নামক এক ব্যক্তির মুখে? গুলাম আলির অনুষ্ঠান বানচালের সময়ও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের মতো বিজেপির শীর্ষ নেতারা নীরব থেকেছেন। বিক্ষিপ্ত ভাবে নিতিন গডকড়ী বা অন্য ছোটখাটো নেতারা মন্তব্য করলেও দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে এর বিরোধ করা হয়নি। এ বারেও সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি লেপার পর লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো নেতা এই ঘটনার ঘোরতর নিন্দা করেছেন। সহিষ্ণুতার বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু এ বারেও বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। সন্ধ্যায় মুম্বইয়ে বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে বেনজির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে মহারাষ্ট্রের দেবেন্দ্র ফডনবীশ সরকার। কিন্তু সেই মুখ্যমন্ত্রীই যে মন্তব্য করছেন, তাতে ভিন্ন বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী যদিও নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু একইসঙ্গে বলেছেন, ‘‘কোনও ভারত-বিরোধী প্রচার এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সহ্য করা হবে না। যদি সেটি দেখা যায়, তা হলে আয়োজকরা দায়ী হবেন।’’
এখানেই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি শিবসেনা যে প্রতিবাদ দেখাচ্ছে, তার পিছনে কি বিজেপি নেতৃত্বেরও প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে?
কংগ্রেস ঠিক এই অভিযোগটিই করছে। দলের নেতা অজয় কুমারের মতে, এটি গোটাটাই বিজেপি ও শিবসেনার গড়াপেটা ম্যাচ। বিহারে যখন ভোট হচ্ছে, সেই সময় শিবসেনার ঘাড়ে বন্দুক রেখে বিজেপি আসলে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করতে চাইছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরব হয়ে। গুলাম আলি একটি অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন শান্তির বার্তা নিয়ে। কাসুরিও শান্তির দৌত্য করতে এসেছেন। মুখে কালি লেপে যাওয়ার পরেও তাই হার মানেননি কুলকার্নি। তিনি বলেন, তেরঙ্গায় কালি লেপা হয়েছে। কাসুরিও সন্ধ্যায় বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেন, তাঁর বইতে ভারত-পাক শান্তি প্রক্রিয়ার কথাই লেখা হয়েছে। অনেক ভুল ধারণা দূর করতেই চেয়েছেন তিনি। বই প্রকাশের এক মাস আগে তিনি বইটি ভারতের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, লালকৃষ্ণ আডবাণী, যশোবন্ত সিন্হাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সত্য ও ইতিবাচক কথা বললেই দুই দেশের মধ্যে আস্থা আরও বাড়বে।
বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে কুলকার্নি এ জি নুরানি, দিলীপ পডগাওকর, নাসিরুদ্দিন শাহের মতো ব্যক্তিত্বদেরও নিয়ে আসেন। প্রসঙ্গক্রমে কুলকার্নি আডবাণীর পাকিস্তান সফরের প্রসঙ্গও টেনে আনেন। বলেন, কাসুরির বইতে আডবাণীর সফর নিয়ে ইতিবাচক কথাই লেখা হয়েছে। জিন্নার প্রশস্তিও করেন। যে পাকিস্তান সফরে জিন্নার প্রশস্তি করে এক সময় আডবাণীকে দলে বড় মূল্য চোকাতে হয়েছিল। কিন্তু উদ্ধব ঠাকরের ছেলে আদিত্য আজ বলেন, কালি এমন ব্যক্তির মুখেই লেপা হয়েছে, যিনি নকশালদের সহমর্মী। যে প্রাক্তন পাক বিদেশমন্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন, তাঁর সঙ্গে উপত্যকার ভারত-বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে যোগ রয়েছে। সে কারণে গতকাল কুলকার্নি শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে দেখা করে এলেও শিবসৈনিকদের আজ নিরস্ত্র করা যায়নি।
বাল ঠাকরে জীবিত থাকার সময়ও শিবসেনা এ ধরনের উগ্র আন্দোলন করত। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের পিচও উপড়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু, সেই সময় আডবাণী বাল ঠাকরের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। এ বারে জমানা বদলেছে। শিবসেনারও আগের মতো দাপট আর নেই। তবু নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের পক্ষ থেকে শিবসেনাকে নিরস্ত্র করার তেমন তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। বরং আরএসএসের আদর্শের প্রভাব এখন ক্রমশই বাড়ছে বিজেপিতে। গুলাম আলির ঘটনার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অরবিন্দ কেজরীবাল সরব হয়ে তাঁদের রাজনীতি করেছেন। স্বভাবত প্রশ্ন উঠছে, বিজেপি নেতৃত্ব চুপ থেকেও কী নিজেদের রাজনীতির রুটি সেঁকছে?