নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মেনে বিদেশের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে আরও এক ধাপ এগোল নরেন্দ্র মোদীর সরকার। এ ব্যাপারে ভারতকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে সুইৎজারল্যান্ড। তাদের দেশের ব্যাঙ্কে কালো টাকা জমা রেখেছেন, এমন সন্দেহভাজন ভারতীয়দের নামের একটি তালিকা তৈরি করে তা দিল্লির হাতে তুলে দেবে বলে এ দিন সুইৎজারল্যান্ড সরকারের তরফে জানানো হয়েছে। সেই তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া শুরুও হয়েছে।
ক্ষমতায় এসেই কালো টাকা উদ্ধারের জন্য প্রাক্তন বিচারপতি এম বি শাহর নেতৃত্বে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট গঠন করে মোদী সরকার। সেই সিটকেও কালো টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে সব রকম সাহায্য করা হবে বলে জানিয়েছে সুইস সরকার। পাশাপাশি তারা এ-ও জানিয়েছে, ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করবে তারা।
সিট-এর প্রধান এম বি শাহ অবশ্য সুইস সরকারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এখনই বিশদে কিছু বলতে নারাজ। তাঁর কথায়, “এটি শুধু কালো টাকার মালিকদের তালিকা নয়। যাঁরা আইনত সুইস ব্যাঙ্কে টাকা রেখেছেন, তাঁদেরও নামের তালিকা। কেউ আইনসম্মত উপায়ে টাকা রাখলে কিছু করার নেই। কিন্তু কালো টাকার সন্ধান পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
নরেন্দ্র মোদীর আগের জমানাতেও বিদেশের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকা উদ্ধারে সক্রিয় হয়েছিল ইউপিএ সরকার। তবে তার পিছনে বড় ভূমিকা ছিল বিরোধী দলগুলির। ইউপিএ জমানায় কালো টাকার প্রশ্নে কংগ্রেস তথা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছিল বিজেপি-সহ সমস্ত বিরোধী দল। তাই ক্ষমতায় এসেই কালো টাকা উদ্ধারে এনডিএ সরকার কতটা সক্রিয়, তা বোঝাতে তৎপর হন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সে কারণে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই তিনি সিট গঠন করেন। যদিও আইনজীবীদের অনেকেই বলছেন, এ ভাবে তড়িঘড়ি সিট গঠনের পিছনে মোদী সরকারের আইনি বাধ্যবাধ্যকতাও ছিল। কালো টাকা উদ্ধার সংক্রান্ত একটি মামলায় সিট গঠনের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। আপ নেতা প্রশান্ত ভূষণও এ দিন সেই প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “সিট গঠন করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। এই ব্যাপারে সরকার কোনও রকম কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না।” কালো টাকার উদ্ধারের জন্য সুইস সরকারের সহায়তায় সিদ্ধান্তে খুশি প্রবীণ আইনজীবী রাম জেঠমলানীও। এ দিন লন্ডন থেকে তিনি বলেন, “আশা করছি সুইস সরকারের দেওয়া তথ্যের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করবে এনডিএ সরকার।”
কালো টাকা নিয়ে রাজনীতি নতুন নয়। বিরোধী দলনেতা থাকাকালীন লালকৃষ্ণ আডবাণী কালো টাকা নিয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল গঠন করেছিলেন। তার অন্যতম সদস্য ছিলেন অজিত দোভাল। যিনি এখন মোদী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। এই টাস্ক ফোর্সের তরফে দাবি করা হয়, তারা অনুসন্ধান করে জেনেছে সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের গচ্ছিত কালো টাকার পরিমাণ প্রায় ২৫,০০০ লক্ষ কোটি টাকা! যদিও সে ব্যাপারে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধারের দাবি জানিয়ে রীতিমতো রথযাত্রাও করেন আডবাণী।
আডবাণীর বিশেষ দল সুইস ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকার পরিমাণ যা-ই বলুক না কেন, সুইৎজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, ২০১৩ সালে সেখানে ভারতীয়দের গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ৪৩% বেড়ে হয়েছে ১৪,০০০ কোটি টাকা। সুইস প্রশাসনের এক কর্তা জানান, এই রকম ধারণা আছে, তাঁদের দেশের ব্যাঙ্কগুলিতে ভারতীয়দের কয়েক লক্ষ কোটি কালো টাকা রয়েছে। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। দেশের ২৮৩টি ব্যাঙ্কে গোটা বিশ্বের ১.৬ লক্ষ কোটি ডলারের মতো রয়েছে বলে দাবি তাঁর।
বস্তুত নরেন্দ্র মোদীও একই কথা বলেছেন। লোকসভা ভোটের প্রচারে কালো টাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি জানিয়েছেন বিষয়টি নিয়ে প্রথমে তদন্ত করে দেখা হবে সত্যিই বিদেশের ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের গচ্ছিত কালো টাকার পরিমাণ কত।
মনমোহন সিংহের জমানাতেও মুষ্টিমেয় কিছু লোকের তালিকা সুইস সরকার কেন্দ্রকে দিয়েছিল। কিন্তু সেই তালিকা প্রকাশ করেনি কেন্দ্র। বন্ধ খামে সেই সব নামের তালিকা সুপ্রিম কোর্টে জমা দিয়ে দেয় তারা। বিরোধীদের প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, তালিকা প্রকাশ করা যাবে না। তা হলে সুইস সরকার আর কোনও তথ্য দেবে না বলে জানায়।
ঘটনাচক্রে, সুইৎজারল্যান্ড ভারতকে মুষ্টিমেয় লোকের তালিকা দিলেও আমেরিকাকে পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিয়েছিল। সে সময় বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ ছিল, মনমোহন সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই আমেরিকাকে পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিলেও ভারতকে তা দেয়নি সুইৎজারল্যান্ড। এখন সুইস সরকার ভারতকে সব সাহায্য করতে রাজি হওয়ায় বিজেপির দাবি, মোদী সরকারের কূটনীতির দৌলতেই এই সাফল্য এসেছে।
বিজেপি নেতৃত্ব নিজেদের পিঠ চাপড়ালেও বিরোধী নেতারা এ নিয়ে বিশেষ হইচই করতে নারাজ। এ দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছেন তাঁরা। বিরোধীদের বক্তব্য, ইউপিএ আমলে সুইৎজারল্যান্ড তালিকা দিয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সুইস সরকার তালিকা দিলে তা প্রকাশ করার জন্য মোদী সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে সিপিআই।