কেন্দ্রকে মুডি’জ-এর হুঁশিয়ারি, সংস্কারেও বাধা গোমাংস বিতর্ক

অন্দরমহলে যে আশঙ্কা দানা বাঁধছিল, সেটাই এ বার সতর্কবাণী হিসেবে শোনা গেল। তা হল— গোমাংস-বিতর্কে ধাক্কা খেতে পারে দেশের অর্থনৈতিক ভাবমূর্তি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:১৫
Share:

অন্দরমহলে যে আশঙ্কা দানা বাঁধছিল, সেটাই এ বার সতর্কবাণী হিসেবে শোনা গেল। তা হল— গোমাংস-বিতর্কে ধাক্কা খেতে পারে দেশের অর্থনৈতিক ভাবমূর্তি।

Advertisement

আর্থিক পরিস্থিতির বিশ্লেষক সংস্থা ‘মুডি’জ অ্যানালিটিক্স’ নরেন্দ্র মোদীকে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে— ‘দলের নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করুন। না হলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে আপনার সরকার।’ মুডি’জ-এর এই রিপোর্টে প্রবল অস্বস্তিতে পড়েছে এমনিতেই নাগরিক সমাজের তোলা অসহিষ্ণুতার অভিযোগ নিয়ে চাপে থাকা মোদী সরকার।

বস্তুত অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি থেকে অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা, সকলেই এমন একটা আশঙ্কা করছিলেন। তাঁদের চিন্তা ছিল, যে ভাবে জাতীয় রাজনীতিতে বিতর্কের কেন্দ্র সামাজিক অসহিষ্ণুতার দিকে ঘুরে গিয়েছে, তাতে আর্থিক সংস্কারে বাধা আসতে পারে। কারণ বিরোধীরা সংসদে এই বিষয়েই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবেন। মাঝখান থেকে হোঁচট খাবে আর্থিক সংস্কারের কর্মসূচি বা সে বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে তোলার প্রয়াস।

Advertisement

গত কয়েক দিনে সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞানীরা মোদী জমানায় অসহিষ্ণুতার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন। সকলেই বলছেন— অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, বাড়ছে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার রক্তচক্ষু প্রদর্শন। বিজেপি ও সঙ্ঘ-পরিবারের নেতারাই তাতে ইন্ধন দিচ্ছেন। দাদরির ঘটনার পরে যেমন বিজেপি নেতারা ক্রমাগত উস্কানিমূলক বিবৃতি দিয়ে গিয়েছেন, তেমনই সব দেখেশুনেও মুখ বুজে থাকছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার প্রতিবাদেই সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-চলচ্চিত্রকাররা পুরস্কার ফিরিয়েছেন।

কোনও প্রভাবশালী আর্থিক বিশ্লেষক সংস্থাও যে মোদীর এই ‘নীরবতা’ নিয়ে সমালোচনায় সরব হতে পারে, তা সরকার বা শাসক দলের কেউ আঁচ করতে পারেননি। কিন্তু আজ ‘মুডি’জ অ্যানালিটিক্স’ তার ‘ইন্ডিয়া আউটলুক: সার্চিং ফর পোটেনশিয়াল’ রিপোর্টে সাফ বলে দিয়েছে, ‘মোদীকে অবশ্যই তাঁর দলের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করা চাই। না হলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর ঝুঁকি সামলাতে হবে।’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজে বিষয়টি থেকে সরে থেকেছেন। কিন্তু জাতিগত উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।’

স্বাভাবিক ভাবেই মুডি’জ-এর এই রিপোর্ট বিরোধীদের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দিয়েছে। সাহিত্যিক-ইতিহাসবিদদের সমালোচনাকে ‘ভেকধারীদের কৃত্রিম বিদ্রোহ’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তাঁর অভিযোগ ছিল, এর পিছনে কংগ্রেস ও বামপন্থীদের হাত রয়েছে। আজ কংগ্রেসের নেতা আনন্দ শর্মা পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেছেন— ‘‘মুডি’জ-এর এই রিপোর্টও কি আমাদের বানানো?’’

বিজেপির মুখপাত্র সম্বিত পাত্রের যুক্তি, দাদরি বা যুক্তিবাদীদের খুনের মতো যে সব ঘটনা নিয়ে হইচই হচ্ছে, সেগুলি সবই স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা। তার জন্য রাজ্য সরকারকে দায়ী করা চলে, কেন্দ্রকে নয়। বিজেপি নেতাদের উস্কানিমূলক বক্তব্য নিয়ে তাঁর যুক্তি, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ নিজে ওই সব নেতাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু কংগ্রেসের নেতারা বলছেন, কে কাকে সতর্ক করে! বিহার ভোটের প্রচারে অমিত শাহ নিজেই তো পাকিস্তান থেকে শুরু করে নানা ধরনের উস্কানিমূলক মন্তব্য করে ভোট মেরুকরণের চেষ্টা করছেন। মুডি’জ-এর রিপোর্ট আসলে তাঁর দিকেও ইঙ্গিত করছে।

মুডি’জ-এর এই রিপোর্টের সঙ্গে অর্থনীতিবিদরা অনেকেই একমত। তাঁদের বক্তব্য, মুডি’জ মোদী সরকারের বাস্তব সমস্যাটাই তুলে ধরেছে। কী সেই বাস্তব সমস্যা? তা হল, লোকসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে এলেও রাজ্যসভায় মোদী সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাব। মোদী সরকারের আর্থিক সংস্কারের বিলগুলি সেখানেই মুখ থুবড়ে পড়ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিজেপি নেতৃত্ব নিজের পায়ে কুড়ুল মারছে। অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বিতর্ক তুলে বিরোধীদের চটিয়ে ফেলছে। ফলে অর্থনৈতিক সংস্কারেও সমর্থন মিলছে না। মুডি’জ-এর

রিপোর্ট বলছে, ‘শাসক দল বিজেপির রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। আর্থিক সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলি বিরোধীদের বাধার মুখে পড়ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধীদের সমর্থন আদায়ে কিছুই করেনি সরকার। উল্টে বিভিন্ন বিজেপি সদস্য বিতর্কিত মন্তব্য করছেন।’ এর আগে রাহুল বজাজের মতো শিল্পপতিরা বলেছিলেন— মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বিনিয়োগকারী বা শিল্পমহলের যে উন্মাদনা ছিল, তা উবে গিয়েছে। একই কথা বলছে মুডি’জও। রিপোর্টে দেখানো হয়েছে— নতুন সরকারকে ঘিরে ‘ইউফোরিয়া’-র ধাক্কায় শেয়ার সূচক যেখানে উঠে গিয়েছিল, ইতিমধ্যেই সেখান থেকে প্রায় ১১ শতাংশ পড়েছে। জরুরি আর্থিক সংস্কার রূপায়ণে একের পর এক ধাক্কা সব আশায় জল ঢেলে দিয়েছে।

মোদী সরকারের জমি বিল বা পণ্য-পরিষেবা কর বিল হোঁচট খেয়েছে। শ্রম আইনের সংস্কারও বিরোধিতার মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মুডি’জ-এর মতে, সংস্কারের এই গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলি পাশ হলে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়বে। কারণ এইসব সংস্কারের ফলে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে। ফলে বৃদ্ধির হার ৭.৬ শতাংশে পৌঁছতে পারে। এই বিলগুলি চলতি বছরে আর পাশ হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু ২০১৬-য় সেই সম্ভাবনা রয়েছে।

এত দিন মোদী সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে সুদ কমানোর দাবি তুলছিল। মূল্যবৃদ্ধির হার কমায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদ কমিয়েছে। কিন্তু শুধু মূল্যবৃদ্ধি বা সুদ কমলেই যে অর্থনীতির রথ ছুটতে শুরু করবে, এমনটা মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, এতে স্বল্প মেয়াদে কিছু লাভ হলেও আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষমতাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে সংস্কার জরুরি। আর সেখানেই ব্যর্থ হচ্ছে মোদী সরকার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement