নির্বাচনের মুখে কংগ্রেস যখন মেরুকরণের রাজনীতিকে উস্কে দিতে চাইছে, তখন পাল্টা জবাব দিতে বিতর্কের মুল সুরটি উন্নয়নের প্রশ্নেই বেঁধে দিতে চাইছে বিজেপি।
বিজেপির নরেন্দ্র মোদী কিংবা যশবন্ত সিন্হারা আজ কংগ্রেসকে অনুন্নয়ন ও দুর্নীতি প্রশ্নে বিঁধতে চেয়েছেন। আর কংগ্রেস নতুন করে উস্কে দিতে চেয়েছে মেরুকরণের রাজনীতিকেই। কিছু দিন আগেই নরেন্দ্র মোদীকে হিটলার আখ্যা দিয়েছিলেন রাহুল গাঁধী। দু’দিন আগে এক ভিডিওতে নরেন্দ্র মোদীকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলার হুমকি দিতে দেখা যায় উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরের কংগ্রেস প্রার্থী ইমরান মাসুদকে। গত কাল সাহারানপুরে মাসুদের বয়ানের নিন্দা করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর হয়েই প্রচার করতে দেখা যায় রাহুলকে। শুধু তিনিই নয়, একসময়ে মোদীকে মৃত্যুর সওদাগর বলা সনিয়া গাঁধী আজ দিল্লির করোলবাগে কার্যত মেরুকরণের সুরেই আক্রমণ শানিয়েছেন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, “কিছু লোক এ দেশের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যকে বিশ্বাস করেন না।” মোদীকে নিশানা করে সনিয়ার মন্তব্য,“কেউ কেউ দেশভক্তির ঢাক পেটান। যারা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনাতেই বিশ্বাসী নয়, তারা কীভাবে দেশ ভক্তি অনুভব করবেন?” এ সব দেখে বিজেপি শিবির মনে করছে, ভোটের ঠিক মুখে কৌশলগত ভাবেই মেরুকরণের রাজনীতির পথে হাঁটছে কংগ্রেস শিবির। যাতে দশ বছরের ইউপিএ শাসনে দুর্নীতি, অনুন্নয়ন, নীতি পঙ্গুতা, বেহাল অর্থনীতির মতো বিষয়গুলি কৌশলে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হন সনিয়া-রাহুলেরা।
বিজেপির মতে, গোটা দেশে এখন কংগ্রেস বিরোধী হাওয়া। দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি, নিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আম আদমির যে রোষ তাকেই হাতিয়ার করে প্রচার চালাতে চাইছে বিজেপি। তাই আজ মহারাষ্ট্রে নরেন্দ্র মোদী আদর্শ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত অশোক চহ্বাণের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। আর বিজেপির স্মৃতি ইরানি বা যশবন্ত সিন্হারা দেশের বেহাল অর্থনীতির পিছনে কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়ে মুখর। বিজেপি চাইছে প্রচারের সুরটি বাঁধা থাকুক উন্নয়নকে ঘিরেই। এক দিকে তুলে ধরা হবে গুজরাতের ‘উন্নয়ন মডেল’। অন্য দিকে আক্রমণ শানানো হবে দশ বছরের ইউপিএ সরকারের ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে।
কিন্তু উন্নয়ন-অনুন্নয়নের এই বিতর্কের জবাবে কংগ্রেস পরিকল্পিত ভাবেই মেরুকরণের তাস খেলছে বলেই মনে করছে বিজেপি শিবির। দলের এক নেতার কথায়, “কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী কৌশলগত ভাবে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ওঠা অনুন্নয়ন, দুর্নীতির অভিযোগ পাশ কাটিয়ে গিয়ে সব দায় ঠেলে দিতে চাইছেন মনমোহন সিংহের ঘাড়ে। উল্টে রাহুল একশো দিনের কাজ বা খাদ্য নিরাপত্তার মতো প্রকল্পগুলির কৃতিত্ব নিতে চাইছেন। নতুন স্বপ্ন ফেরি করতে চাইছেন।” কংগ্রেসের কৌশল ঠেকাতে আগামী দিনগুলিকে ইউপিএ-র ব্যর্থতাকেই মূলধন করে প্রচার চালাতে চাইছে বিজেপি শিবির। যাতে বিরোধী দলের আক্রমণের মুখে পড়ে অভিযোগের জবাব দিতে বাধ্য হয় কংগ্রেস।
সেই লক্ষ্যেই কাল ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার ক্ষমতা দখলের আগে বাজপেয়ী সরকারের সময়কার তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে কংগ্রেসকে আক্রমণ শানান বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ। আজও একই ভাবে দেশের বেহাল অর্থনীতি প্রশ্নে কংগ্রেস তথা মূলত কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী চিদম্বরমের ভূমিকার সমালোচনা করেন বাজপেয়ী সময়কার অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হা। তাঁর কথায়, “দশ বছর বিপিএল সমীক্ষা হয়নি। যোজনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রক বলছে দেশে গরিব কমছে। কিন্তু এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক ২০১২ সালে জানায়, গরিবি রেখার নীচে থাকা মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে। কমেছে বিনিয়োগ। ফলে এনডিএ আমলের মতো রোজগারও সৃষ্টি হয়নি।” যশবন্তের অভিযোগ, “আট বছর আগে আমাদের বিদেশী ঋণ ছিল ১৩৯ বিলিয়ন ডলার। আর এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪২৬ বিলিয়ন ডলার। কমেছে বিদেশি মুদ্রা ভাণ্ডার। ফলে বিদেশে ভারতের রেটিংও কমেছে।” অর্থনীতি ছাড়াও, বিদ্যুত্, সড়ক কিংবা কৃষি ক্ষেত্রেও দেশ পিছিয়ে পড়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যশবন্ত।
আক্রমণ শানাতে আজ পরিকল্পিত ভাবেই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যশবন্তকে মাঠে নামানোর সিদ্ধান্ত নেন বিজেপি নেতৃত্ব। দলের পরিকল্পনা ছিল এনডিএ জমানার আর এক প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিংহকে দিয়েও একই ভাবে আক্রমণ শানানোর। কিন্তু আপাতত তাঁর সঙ্গে দলের সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ায় আগামী দিনে যশবন্তকেই আরও বেশি করে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল। যশবন্তকে এই দায়িত্ব দিয়ে দলের প্রবীণ নেতাদের কাছে তাঁদের গুরত্ব দেওয়ারও বার্তা দিতে চাইছেন বিজেপি নেতৃত্ব।