‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ বলে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সরব থাকে সিপিএম। কিন্তু রাশিয়া যখন ইউক্রেনে সেনা পাঠায়, তখন সেই সিপিএম নেতৃত্বই নীরব থাকা সঙ্গত মনে করেন।
বিশ্বের বহু দেশের নেতাই ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা পাঠানো নিয়ে উদ্বিগ্ন। অভিযোগ উঠেছে, ইউক্রেন দখলের চক্রান্ত করছে রাশিয়া। তাঁরা বলছেন, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হতে দেওয়া চলবে না। কিন্তু কমিউনিস্ট নেতারা মনে করছেন, রাশিয়া নয়, আমেরিকাই ইউক্রেনের অন্দরমহলে নাক গলাচ্ছে। ভ্লাদিমির পুতিনকে চাপ দিতে গেলে বারাক ওবামাই প্যাঁচে পড়বেন।
গত আড়াই দিন ধরে দিল্লিতে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক চলছিল। আজ কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি জারি হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি শুরুই হয় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি দিয়ে। তা সে হন্ডুরাসই হোক বা সাইপ্রাস। কিন্তু ইউক্রেন নিয়ে যখন আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘাত চলছে, ওই দেশ থেকে সেনা না সরালে পুতিনের দেশকে মূল্য চোকাতে হবে বলে হুমকি দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি নীরব। কেন? দলের উত্তর, এ বারের কেন্দ্রীয় কমিটিতে লোকসভা ভোটের প্রস্তুতি, প্রার্থী তালিকা নিয়েই আলোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলোচনা না হলেও সিপিএমের নেতারা কিন্তু পরোক্ষে রাশিয়ারই পাশে। কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নীলোৎপল বসু বলেন, “মার্কিন সেনেটের সামনে সন্ত্রাসবাদী হামলা হলে কি বারাক ওবামা তাঁর সেনাকে ব্যারাকে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন? আসলে আমেরিকাই প্যাঁচে পড়ে গিয়েছে। পুতিন পুরোপুরি উজ্জীবিত। তাঁর সঙ্গে আমেরিকা মাতব্বরি করতে গেলে গোটা বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হবে।”
এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গ ছিল ইউক্রেন। সে দেশের রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ পদচ্যুত হওয়ার পর থেকেই ইউক্রেনে রুশ সেনার অভিযান নিয়ে জল্পনা চলছে। ইউক্রেনের উপদ্বীপ ক্রিমিয়ায় নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চান পুতিন। কারণ সেখানেই রয়েছে রাশিয়ার সব থেকে বড় নৌঘাঁটি। ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ার কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। রাশিয়ার বক্তব্য, ইউক্রেনের রুশভাষী জনগণকেও রক্ষা করার দায়িত্ব রয়েছে মস্কোর। বিশেষ করে ক্রিমিয়ায় রুশরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইউক্রেনের তদারকি প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার তুর্কিনভের ভয়, এ সব বলে সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি করে রাশিয়া সেনা পাঠিয়ে ইউক্রেন দখল করতে পারে।
সিপিএম নেতারা কিন্তু মনে করছেন, ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের নেতৃত্বে ইউক্রেনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই নির্বাচিত সরকার গঠন হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সেই সরকারকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, তা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। নীলোৎপল বসু বলেন, “দুই মার্কিন কর্তার মধ্যে কথোপকথনের রেকর্ড ফাঁস হয়ে গিয়েছে। সেখান থেকেই স্পষ্ট, আমেরিকা নিজেদের ঘুঁটি সাজাচ্ছিল।” তাঁর যুক্তি, ইউক্রেন আসলে স্পষ্ট ভাবে বিভাজিত দু’টো রাষ্ট্র। ক্রিমিয়া স্বশাসিত অঞ্চল। সোভিয়েত জমানায় ইউক্রেন শিল্প উৎপাদনের শিখরে ছিল। কিন্তু মুক্ত অর্থনীতির যুগে আন্তর্জাতিক পুঁজির চক্করে পড়ে মন্দার ধাক্কা লেগেছে সেই দেশেও। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে খরচ ছাঁটাইয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল, ইউক্রেন তা মানেনি। ইউক্রেনের একটা অংশ রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছে। আর তাতেই আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের গোঁসা হয়েছে।
আর তাই রাশিয়া অন্য দেশে সেনা পাঠালেও তাতে অন্যায় কিছু দেখছেন না সিপিএমের নেতারা। দিল্লির রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, বরাবরই চিন ও রাশিয়াকে নিয়ে সিপিএমে ধন্দ রয়েছে। চিন অরুণাচল প্রদেশের ক্ষেত্রে যে অবস্থানই নিক না কেন, সিপিএম কোনওদিনই ‘সাম্রাজ্যবাদী চিন নিপাত যাক’ বলে রাস্তায় নামে না। উল্টে নয়াদিল্লি ও বেজিংয়ের আলোচনা করে সীমান্ত নিয়ে বিবাদ মিটিয়ে ফেলার পক্ষেই সওয়াল করে। অতীতেও সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আফগানিস্তানে সেনা পাঠিয়েছে, তখনও তার সমালোচনা করতে অনেক সময় নিয়েছিল সিপিএম। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করছেন, শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করতে পুতিন এখন স্তালিনকে ফিরিয়ে আনছেন। ফলে রাশিয়াকে নিয়ে ফের ধন্দে পড়েছেন সিপিএম নেতৃত্ব। তাই ঘোষিত কোনও অবস্থান না নেওয়াটাকেই শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছেন তাঁরা।