‘লকেট’হীন হলেন নেত্রী। দীর্ঘদিনের সঙ্গী বসু পরিবারও সরে গেল। সুপ্রিম কোর্টে ঠোক্কর খেয়ে ফিরে এল সারদা তদন্তে নজরদারির আবেদন। ফের উল্টো গাইলেন সাংসদ সুগত বসু। এমনই এক চতুর্মুখী সঙ্কটের সন্ধ্যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হঠাৎ একটি টুইট। দিল্লিবাসীকে উদ্দেশ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, “আগামী ৭ তারিখ দিল্লির নির্বাচন। দিল্লির সবাইকে আমার অনুরোধ, দয়া করে আম আদমি পার্টিকে ভোট দিন। দিল্লির উন্নয়ন এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তা প্রয়োজন।”
এমন নয় যে, নিজের রাজ্যে মাথা ঘামানোর মতো বিষয়ের অভাব রয়েছে মমতার। বরং এই মুহূর্তে তা পর্যাপ্ত। আবার এমনও নয় যে, পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি তৃণমূলের কোনও কাজে আসবে। কেন্দ্রে আপ-এর সঙ্গে জোট বেঁধে কোনও তৃণমূল নেত্রীর কোনও রাজনৈতিক প্রকল্পের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা দেখা যায়নি এত দিন। বরং গত লোকসভা ভোটে দিল্লিতে তাদের সঙ্গে টক্কর দিতে প্রাক্তন বলিউড তারকা বিশ্বজিৎ-সহ একাধিক প্রার্থী দিয়েছিল তৃণমূল। কেউই জিততে পারেননি। বিশ্বজিৎ জামানত বন্ধক রেখে ফিরে গিয়েছিলেন মুম্বই।
তবে আজ হঠাৎ কেন এই টুইট?
রাজ্য থেকে রাজধানী কারও কাছেই সদুত্তর নেই। ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা ব্যাখ্যা। কেউ বলছেন, গত কাল দিল্লির সভায় অরবিন্দ কেজরীবালকে বিঁধতে গিয়ে মমতার নাম তুলেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। বলেছিলেন, মমতা, নীতীশ কুমার-সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক নেতা-নেত্রীকে তাঁদের রাজ্যের মানুষ কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। কট্টর মোদী-বিরোধী তৃণমূল নেত্রী যে পত্রপাঠ ওই মন্তব্যের থেকে দূরত্ব বাড়াতে চাইবেন, সেটা খুব স্বাভাবিক। অনেকের ব্যাখ্যা, দিল্লি ভোটে মোদী-বিরোধী মুখ হিসেবে কেজরীবাল উঠে আসার পর কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কের একটা বড় অংশই ঝুঁকে পড়েছে আপ-এর দিকে। এই পরিস্থিতিতে ২০১৬ বিধানসভা ভোটের আগে কংগ্রেসকে কিছুটা চাপে রাখতেই আপ-এর পক্ষ নিলেন মমতা।
আবার অনেকের এ-ও মত, ভোটের আগে বিভিন্ন সমীক্ষা কেজরীবালের পুনরুত্থানের আভাস দিচ্ছে। রাজধানীতে শেষ পর্যন্ত বিজেপি-বিরোধী সরকার এলে এবং ভোটের আগে থেকেই তাদের বন্ধুত্বের বার্তা দেওয়া থাকলে মমতারই লাভ।
একটা সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে কেজরীবালকে নিয়ে কিছুটা মাথাব্যথাই ছিল মমতার। তৃণমূল নেত্রীর মতোই ধর্না-অবস্থান, আমজনতার রাজনীতি করে তাঁর উত্থান। ফলে ‘আম আদমি’-র যথার্থ প্রতিনিধি কে, সে বিষয়ে দু’জনের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন চাপানউতোর ছিলই। সেই মনোভাব থেকেও আজ সরে এলেন মমতা। প্রসঙ্গত, লোকসভা ভোটের আগে মমতার সরল জীবনযাত্রার কথা বলে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরেছিলেন কেজরীবালের প্রাক্তন ‘গুরু’ অণ্ণা হজারে। অবশ্য তার দিন কয়েকের মধ্যেই মমতাকে বিড়ম্বনায় ফেলেছিলেন তিনি। দিল্লির রামলীলা ময়দানে তাঁদের যৌথ সভায় লোকই হয়নি। সম্মানহানির ভয়ে অণ্ণা সে দিন সভামুখোই হননি। আর মমতা বক্তৃতা করেছিলেন ফাঁকা ময়দানে।
সেই সভার কথা তুলেই আজ মমতাকে কটাক্ষ করেছেন সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম। বলেছেন, “ওই দিনের পর দিল্লির কেউ কি আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টুইট ফলো করে? আপ বিজেপিকে রীতিমতো চাপে ফেলে দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মমতার এই অযাচিত আশীর্বাদ তাদের সর্বনাশ না ডেকে আনে!” পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহও মনে করেন, এক সময় দিল্লিতে এক হাজারও লোক জড়ো করতে না-পারা মমতা আজ বাংলার বাইরে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে এমন মন্তব্য করেছেন। উল্টে তাঁর অভিযোগ, “এক জন হাওয়ালার রানি, আর এক জন হাওয়ালার রাজা! যে ভাবে মধ্যরাতে কেজরীবালের দলের তহবিলে দু’কোটি টাকা পড়ে, ঠিক সেই ভাবেই তৃণমূলের তহবিলে এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা পড়েছিল। এই দু’টি দলই যে একে অপরের পিঠ চাপড়াবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!” সারদা মামলার মূল হোতা আব্দুল মান্নান আবার মস্করার মেজাজে। বললেন, “আমি যদি আজ আমেরিকার নির্বাচনে সে দেশের নাগরিকদের আহ্বান জানাই যে, তাঁরা যেন বারাক ওবামাকে সমর্থন করেন? মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যটিও কতকটা সেই ধাঁচের।”
কী বলছে আপ? মুখপাত্র দীপক পাণ্ডে এটুকু বলেই ক্ষান্ত দিলেন “যে কোনও মঞ্চ থেকে সমর্থন এলে তাকে স্বাগত। অনেক ধন্যবাদ। ব্যস, আর কিচ্ছু বলার নেই!”