ফের বিতর্কে আদিত্যনাথ। ফাইল চিত্র।
২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী শ্মশান ও কবরস্থানের তুলনা টেনেছিলেন। তাতে বিতর্ক হলেও মেরুকরণের ফায়দা কুড়িয়েছিল বিজেপি। পাঁচ বছর পরে, ২০২২ সালে ওই রাজ্যে ভোটের আগে ‘আব্বাজান’ নিয়ে বিতর্ক আমদানি করলেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
রবিবার কুশীনগরে এক জনসভায় যোগী বলেন, ২০১৭ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে গরিবরা রেশন পেতেন না। কারণ, আব্বাজান বলা লোকজনরাই সব রেশন হজম করে ফেলতেন। কিছু দিন আগে সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিংহ যাদবকে ‘আব্বাজান’ বলে ইঙ্গিত করেছিলেন যোগী।
গত সপ্তাহে এমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি উত্তরপ্রদেশে ভোটের ময়দানে নেমেছেন। তার আগে সমাজবাদী পার্টির এক মুসলিম নেতার বিরুদ্ধে তালিবানের হয়ে সওয়াল করার অভিযোগ তুলেছিল বিজেপি। ফলে প্রেক্ষাপট তৈরিই ছিল। যোগী এর মধ্যেই আব্বাজান প্রসঙ্গ টেনে এনে নতুন করে মুসলিম তোষণের অভিযোগ তুলে দিলেন। এ বার যোগীর মন্তব্যের পরে তাঁর বিরুদ্ধে পুরো বিরোধী শিবির এক হয়ে অভিযোগ তুলেছে, কোভিডের দ্বিতীয় ধাক্কা মোকাবিলায় ব্যর্থতা, বিভিন্ন জাতিবর্গের ক্ষোভ, অনুন্নয়ন ও বেকারত্বের সমস্যা ঢাকতেই যোগী তথা বিজেপি নেতৃত্ব সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের তাস খেলতে চাইছেন।
২০১৭ সালে খোদ মোদী ভোটের প্রচারে গিয়ে মুসলিম তোষণের অভিযোগ তুলে বলেছিলেন, ‘‘গ্রামে কবরস্থান তৈরি করা হলে শ্মশানঘাটও তৈরি করতে হবে। রমজানের সময়ে বিদ্যুৎ দেওয়া হলে, দীপাবলির সময়েও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে।’’ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে যোগীর ‘আব্বাজান’ মন্তব্যের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই মঙ্গলবার আলিগড় যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে ‘জাঠ রাজা’ হিসাবে পরিচিত রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ সিংহের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিলান্যাস করবেন তিনি। কার্যত মঙ্গলবার থেকেই মোদী ভোটের প্রচার শুরু করে দিচ্ছেন।
রাজনৈতিক শিবির বলছে, বিজেপির অঙ্কটা খুব সহজ। কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠরা এখন বিজেপির উপরে ক্ষুব্ধ। মুজফ্ফরনগরের সাম্প্রতিক মহাপঞ্চায়েতে তা স্পষ্ট। সাম্প্রদায়িক অশান্তির ইতিহাসবিধৃত মুজফ্ফরনগরে
মুসলমানদের সঙ্গে জাঠদের কৃষি আন্দোলনকেন্দ্রিক সখ্য দেখা গিয়েছে। জাঠ ভোটের সঙ্গে মুসলমান আবেগ যুক্ত হলে, আখেরে লাভবান হবেন অখিলেশ সিংহ যাদব। বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব পাল্টা চালে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের গৌরবভাষ্য তৈরির পরিকল্পনা করেছে। এক দিকে জাঠ ক্ষোভকে কিছুটা প্রশমিত করা, অন্য দিকে আলিগড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি দান করেও জাঠ রাজার স্বীকৃতি না পাওয়ার ক্ষোভকে উস্কে দেওয়া।
যোগীর এই মন্তব্যের পরে বিরোধীদের সমালোচনার পাশাপাশি নেট-দুনিয়াতেও নিন্দা, কটাক্ষ শুরু হয়েছে। বহু মানুষ নিজের বাবার কথা লিখে বা ছবি দিয়ে ‘আব্বাজান’ বলে উল্লেখ করেছেন। যা দেখে রাজনীতিকরা বলছেন, যোগী ঠিক এই প্রতিক্রিয়াই চাইছিলেন। আব্বাজান মন্তব্যের যত সমালোচনা হবে, ততই বিজেপির পক্ষে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক মজবুত হবে। গতকালও অবশ্য একটি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফে ছাপা বিজ্ঞাপনধর্মী প্রতিবেদনে কলকাতার উড়ালপুল ‘মা’-এর ছবি ফলাও করে দেওয়া নিয়ে সরব ছিল নেট দুনিয়া।
আজ কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী টুইট করেছেন, “আপনি হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, মুসলমান—কারও নন। আপনি শুধু মিঁত্রো-র! আপনি দেশের নন, সাধারণ মানুষেরও নন।” ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ওমর আবদুল্লার অভিযোগ, “মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ এবং ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া অন্য কোনও বিষয় নিয়ে নির্বাচন লড়ার ইচ্ছা বিজেপির নেই।” তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের প্রশ্ন, ভারতের এক জন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধি লঙ্ঘনের জন্য সুপ্রিম কোর্ট কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা শুরু করবে? এ দিন বিহারের মুজফ্ফরপুরে একটি মামলা দায়েরও হয়েছে যোগীর নামে। মামলাকারী সমাজকর্মী তমন্না হাশমির অভিযোগ, মুসলিম ভাবাবেগে ধাক্কা দিয়েছে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্য।
বিজেপির প্রাক্তন সদস্য, লেখক এবং ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ প্রচারের প্রধান রূপকার সুধীন্দ্র কুলকার্নিও টুইট করেছেন। তাঁর কথায়, “২০২২ সালের উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রী আব্বাজান প্রসঙ্গ তুললেন। ২০১৭ সালে ওই রাজ্যে ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী কবরস্থানের কথা বলেছিলেন। এগুলি নিছকই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। ২০২৪ সালের (লোকসভা ভোটের) আগে এ রকম আরও অনেক ঘটনার সাক্ষী হবে ভারত।”