National News

শেষ হাসি সীতারই, কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাবেই সিলমোহর

দলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক লাইন কী হবে, তা নিয়েই সবচেয়ে বড় টানাপড়েন শুরু হয়েছিল সিপিএমের অন্দরে। পার্টি কংগ্রেস শুরুর অনেক আগে থেকেই চলছিল এই টানাপড়েন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৮ ২২:৫৭
Share:

সীতারাম ইয়েচুরি। ফাইল চিত্র।

পিছু হঠলেন প্রকাশ কারাট। শুক্রবার সকাল পর্যন্তও ২২তম পার্টি কংগ্রেসের আসরে অসীম দাপট বজায় রেখেছিলেন সিপিএম-এর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু বেলা যত গড়াল, ছবিটা ততই বদলে গেল ধীরে ধীরে। রাজনৈতিক প্রস্তাবের সরকারি খসড়া সংশোধন করে ইয়েচুরির প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্তি ঘটানো হল তাতে। সংসদের ভিতরে তো বটেই, বাইরেও সমঝোতা হতে পারে কংগ্রেসের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত নিল সিপিএমের ২২তম পার্টি কংগ্রেস।

Advertisement

দলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক লাইন কী হবে, তা নিয়েই সবচেয়ে বড় টানাপড়েন শুরু হয়েছিল সিপিএমের অন্দরে। পার্টি কংগ্রেস শুরুর অনেক আগে থেকেই চলছিল এই টানাপড়েন। বিজেপি-আরএসএস-কে ঠেকাতে কি কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাবে সিপিএম? নাকি কংগ্রেসকেও একই রকম অস্পৃশ্য করে রেখে শুধু বৃহত্তর বাম ঐক্যে জোর দেওয়া হবে? টানাপড়েন শুরু হয়েছিল এই প্রশ্নকে ঘিরেই।

সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার পক্ষে। বাংলার কমরেডদের অধিকাংশই ইয়েচুরির পাশে। কিন্তু কেরল বরাবরের মতো এ বারও কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার কট্টর বিরোধী এবং সে মতের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা প্রকাশ কারাট নিজেই।

Advertisement

২২তম পার্টি কংগ্রেস শুরুর আগে কেন্দ্রীয় কমিটির যে বৈঠক বসেছিল, তাতে কারাটের মতামতই অনুমোদন পায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন নিজের দিকে ধরে রেখে সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরির প্রস্তাব খারিজ করিয়ে দেন কারাট। ফলে পার্টি কংগ্রেসে দলের তরফ থেকে রাজনৈতিক দলিলের সরকারি খসড়া প্রকাশ কারাটই পেশ করেন, সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি নন। কিন্তু শেষ হাসি ইয়েচুরিই হাসলেন।

কারাট দলের তরফ থেকে সরকারি দলিলটি পেশ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু সে দলিলের উপরে অনেকগুলি সংশোধনী জমা দেন সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিরা। এই বিপুল সংখ্যক সংশোধনী জমা পড়ার সুবাদেই সীতারাম ইয়েচুরি বিকল্প দলিলটি পেশ করার সুযোগ পেয়ে যান। দুই দলিলের উপরেই দীর্ঘ আলোচনা চলে। ক্রমশ ভোটাভুটির দিকে এগোতে থাকে পরিস্থিতি।

আরও পড়ুন: সীতা-প্রকাশ টানাপড়েন জবাবি ভাষণ নিয়েও, ভোটাভুটি গোপন ব্যালটে?

প্রথমে শোনা গিয়েছিল, সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরিকে জবাবি ভাষণ দিতে দেওয়া হবে না। সেটাও কারাটই দেবেন। কারাট শিবিরের যুক্তি ছিল, দলের তরফ থেকে সরকারি দলিল যে হেতু তিনি পেশ করেছেন, সে হেতু জবাবও তিনিই দেবেন। পরে স্টিয়ারিং কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, কারাট এবং ইয়েচুরি, দু’জনেই বলবেন। কারণ দু’জনেই আলাদা আলাদা দলিল পেশ করেছেন।

শুক্রবার দুপুরের দিক থেকেই কিন্তু পার্টি কংগ্রেসের গতিপ্রকৃতির মোড় ঘুরতে শুরু করেছিল। কারাটের সরকারি দলিল পেশ হওয়ার পরেও ইয়েচুরির বিকল্প দলিল পেশ হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। তার পরে আবার রাজনৈতিক দলিল নিয়ে ভোটাভুটির দাবি জোরালো হতে শুরু করেছিল। সেটাও কোনও কোনও মহলে অস্বস্তি বাড়াচ্ছিল। কারাট শিবিরের অস্বস্তি আরও বাড়তে শুরু করেছিল তখন, যখন প্রতিনিধিদের অনেকেই দাবি করেন, হাত তুলে নয়, ভোটাভুটি হতে হবে গোপন ব্যালটে।

আরও পড়ুন: সংশোধনীর পাহাড়ে চেপে যুদ্ধে ইয়েচুরি

সিপিএমের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটি নির্বাচন সংক্রান্ত ভোটাভুটি গোপন ব্যালটে হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলিল সংক্রান্ত বিতর্কে হাত তুলে ভোটাভুটি করাই দস্তুর। রাজনৈতিক দলিল সংক্রান্ত ভোটাভুটি গোপন ব্যালটে করা যাবে না, এমন কথা পার্টির গঠনতন্ত্রে লেখা নেই। রাজনৈতিক দলিলের উপরে গোপন ব্যালটে ভোটাভুটি কখনও হয়নি আগে।

বাংলা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর, তামিলনাড়ু-সহ মোট ১৫টি রাজ্যের প্রতিনিধিরা গোপন ব্যালটে ভোটাভুটির দাবি তোলেন এ দিন। কারাট শিবির সম্ভবত বুঝতে পারছিল, কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার সব দরজা বন্ধ করে দেওয়ার নীতি গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না দলের বিরাট অংশের মধ্যে। গোপন ব্যালটে ভোটাভুটি হলে ফলাফল অত্যন্ত অস্বস্তিকর হতে পারে, এমনটাও সম্ভবত বুঝতে পারছিলেন তাঁরা। তাই শেষ পর্যন্ত দলের অন্দরেই সমঝোতার ফর্মুলা খুঁজে বার করা হল। খুলে গেল কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের সমঝোতার রাস্তা।

আরও পড়ুন: চার বিচারকের বিবৃতিকেই অস্ত্র

প্রকাশ কারাট যে দলিল পেশ করেছিলেন, পার্টি কংগ্রেস সেই দলিলকেই অনুমোদন করল। কিন্তু দলিল সংশোধন করা হল। কারাটের পেশ করা দলিল থেকে প্যারাগ্রাফ ২.১১৫ (ii) বাদ দেওয়া হল। ওই প্যারাগ্রাফে লেখা ছিল যে, কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক জোটে যাবে না সিপিএম। সেই অংশ বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলিলে ঢোকানো হল সীতারাম ইয়েচুরির পেশ করা খসড়ার একটি প্যারাগ্রাফ, যেখানে লেখা রয়েছে— সংসদের অন্দরে কংগ্রেস-সহ সব ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে দল সমঝোতা করতে পারবে...। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রোখার স্বার্থে সংসদের বাইরেও সব ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারবে সিপিএম। কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি জোট গঠন করা হবে না, কিন্তু সমঝোতা করাই যেতে পারে।

ইয়েচুরির প্রস্তাব থেকে এই অংশটি কারাটের খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত হতেই বিরোধ মিটে যায়। কারণ রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণের প্রশ্নে বিরোধ ছিল মূলত কংগ্রেসের হাত ধরা বা না ধরার প্রশ্নেই। সেই বিতর্কের মিমাংসা হয়ে যাওয়ায় আর ভোটাভুটিতে যাওয়ার প্রয়োজন হল না।

পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত এই সিদ্ধান্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সিপিএমের বঙ্গ ব্রিগেড। দীর্ঘ দিন ধরেই কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার পক্ষপাতী এ রাজ্যের সিপিএম নেতারা। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতায় গিয়েছিল এ রাজ্যের বামেরা। তৃণমূলের ‘আগ্রাসী রাজনীতি’ এবং বিজেপি-র উত্থানের সামনে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এখনও এ রাজ্যে হাত মিলিয়েই চলা উচিত সিপিএম-কংগ্রেসের। মনে করেন বাংলার অনেক নেতাই। পার্টি কংগ্রেসে যদিও বলা হয়নি যে, কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গড়তে পারে সিপিএম। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে সংসদের ভিতরে-বাইরে যে ধরনের সমঝোতার প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সেই সমঝোতা থাকলেই দুই দল পরস্পরের অনেক কাছাকাছি আসবে। নেতৃত্বের স্তরে না হলেও, স্থানীয় স্তরে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সমঝোতার বাতাবরণ তৈরি হয়ে যাবে। তাতেই আপাতত রাজনৈতিক লাভ দেখছে সিপিএমের বঙ্গ ব্রিগেড।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement