স্মৃতি: বাবার সেই এক্স-রে মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে পুত্র সুজিত পাল। —নিজস্ব চিত্র।
এ কী অদ্ভুতুড়ে যন্ত্র রে বাবা! সামনে দাঁড়ালেই পাঁজরের ছবিটা তুলে নিচ্ছে অবিকল।
বাঙালি চিকিৎসকের ওই যন্ত্রের কেরামতি দেখে অবাক হয়ে যেতেন গরিবগুরবো আদিবাসীরা। ওই যন্ত্র থেকে বেরোনো ছবি দেখেই আবার অব্যর্থ চিকিৎসা করছেন চিকিৎসকেরা। যন্ত্রটা কি জাদু জানে?
চিকিৎসক সাকেত নিবাস পাল মুচকি হেসে রোগীকে জানাচ্ছেন, এটা এক্স-রে মেশিন।
তখনও স্বাধীন হয়নি ভারত। ওই এক্স-রে মেশিন নিয়ে রাঁচীতে চিকিৎসা শুরু করে কার্যত সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন শ্রীরামপুর থেকে আসা বাঙালি চিকিৎসক সাকেত নিবাস পাল। রাঁচী সদর হাসপাতালেও তখন আসেনি ওই যন্ত্র। শুধু রাঁচী নয়, গোটা ছোটনাগপুর এলাকাতেই তখন এই মেশিন হাতে গোনা। সাকেত নিবাসের কাছে এক্স-রে করাতে আসতেন পুরুলিয়ার রোগীরাও। আসতেন সুদূর ধানবাদ, গিরিডি থেকেও।
সম্প্রতি সাকেত নিবাসের সেই এক্স-রে ক্লিনিকের ৭৫ বছর উদ্যাপন হল। আর সেই ক্লিনিকে এসে নস্টালজিক হয়ে পড়লেন রাঁচীর চিকিৎসকেরা। কী ভাবে এক বাঙালি চিকিৎসক একটা এক্স-রে মেশিনের দৌলতে সেই আমলে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর নানা টুকরো গল্পও উঠে এল। সাকেত নিবাসের ছেলে সুজিত পাল বলেন, ‘‘বাবা ১৯৪২ সালে ওই এক্স-রে ক্লিনিক খুলেছিলেন। তখন মানুষের খুব টিবি হতো। টিবি হলে এক্স-রে করতেই হতো। সে ক্ষেত্রে বাবাই ছিলেন তাঁদের একমাত্র বল-ভরসা।’’
সুজিতবাবু নিজেও চিকিৎসক। তিনি জানান, যে এক্স-রে মেশিন তাঁর বাবা কিনেছিলেন, সেই মডেলটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহার হতো। যুদ্ধে যাঁরা আহত হতেন, তাঁরা অনেকেই হাসপাতালে আসতে পারতেন না। তাই তাঁদের এক্স-রে করার জন্য চিকিৎসক নিজেই মেশিন নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতেন। সুজিতবাবু বলেন, ‘‘বাবাও ছিলেন অনেকটা সেই যুদ্ধক্ষেত্রের চিকিৎসকদের মতো। গ্রামের কোনও গরিব মানুষের হাত-পা ভাঙার খবর পেলে বাবা ওই যন্ত্র গাড়িতে বসিয়ে চলে যেতেন সেই গ্রামে। কখনও লোহারদাগা, তো কখনও পলামু, কখনও আবার গুমলা। আমি কত বার গিয়েছি বাবার সঙ্গে। অনেকর তো ফি-টুকু দেওয়ারও ক্ষমতা ছিল না।’’ সুজিতবাবু জানান, সেই সময় রাঁচীর মানসিক হাসপাতাল রিনপাসের রোগীদের মাথার এক্স-রে করতেও তাঁর বাবার আনা মেশিনই ছিল অন্যতম ভরসা।
আদি বাড়ি শ্রীরামপুর। কিন্তু কর্মসূত্রে সাকেত নিবাস সেই যে ডাক্তারি পাশ করে রাঁচী চলে এসেছিলেন, তার পরে সেখানেই থেকে যান। বাবার সেই পুরনো এক্স-রে মেশিনটিকে যত্ন করে রেখে দিয়েছেন সুজিতবাবু। সুজিতবাবু বলেন, ‘‘বাবা নেই। কিন্তু এই যন্ত্রটার সামনে দাঁড়ালে এখনও মনে হয়, এই বুঝি বাবা মেশিন নিয়ে হন্তদন্ত করে বেরিয়ে পড়ছেন। গ্রামের গরিব মানুষগুলোর এক্স-রে করতে।’’