প্রতীকী ছবি: সৌজন্যে পিক্সঅ্যাবে।
‘পরিবার পরিকল্পনা মানবাধিকারের অঙ্গ’— এই বিষয় সামনে রেখেই ১১ জুলাই গোটা দুনিয়ায় পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পিত পরিবার গঠনের শিক্ষাকেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় এই দিনটিতে। কারণ, কোনও একটি দেশের সার্বিক বিকাশ ও আর্থিক অবস্থান অনেকটাই নির্ভর করে সেই দেশের জনসংখ্যা, তার কর্মক্ষমতা এবং সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর উপর।
১৯৮৭-র ১১ জুলাই বিশ্বের মোট জনসংখ্যা পৌঁছে গিয়েছিল ৫০০ কোটিতে। তার পর থেকেই বিশ্বে জনসংখ্যার চাপ, তার বৃদ্ধিজনিত অপুষ্টি, অপর্যাপ্ত শিক্ষা, বেকারত্ব, চিকিৎসা পরিষেবার অপ্রতুলতা ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে প্রচারে উদ্যোগী হয় রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। তাদেরই উদ্যোগে ১৯৮৯ সালের এই ১১ জুলাই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয় ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ হিসাবে। তার পর থেকে প্রতি বছরই নিত্যনতুন বিষয়কে কেন্দ্র করে পালিত হয়ে আসে এই বিশেষ দিনটি।
কোনও একটি দেশের জনসংখ্যা ও বিশ্বের নিরিখে তার অবস্থান বুঝতে হলে, প্রথমেই চোখ রাখতে হয় আদমসুমারির দিকে। ২০১১-য় ১৫তম ভারতীয় জনগণনা দু’দফায় পরিচালিত হয়— ঘর তালিকাকরণ এবং জনসংখ্যা গণনা । ১৮৭২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ভারতে পরিচালিত আদমসুমারির মধ্যে সে বারই প্রথম বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ৩১ মার্চ, ২০১১ তারিখে প্রকাশিত জনগণনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১২১ কোটি ছাড়িয়েছে। এই ক’বছরে স্বাভাবিক ভাবেই তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার বছরে গড়ে ১৭.৬৪ শতাংশ। এই হারে বৃদ্ধি পেলে ২০৩০ সালের মধ্যেই ভারত বিশ্বে সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ হিসাবে পরিচিত হবে। বর্তমানে জনসংখ্যার বিচারে ভারতের স্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয় (চিনের পরেই)।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আরও পড়ুন: হতাশ হয়ে পড়েন সহজেই? বিনা ওষুধে সুস্থ হয়ে উঠুন এ ভাবে
পরবর্তী আদমসুমারি ২০২১ সালে। তার আগেই বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে আসা রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৬ সালে গোটা বিশ্বে যেখানে জনসংখ্যা ৭৪০ কোটি, সেখানে ভারতের জনসংখ্যা ১৩০ কোটির উপরে। অর্থাৎ দুনিয়ার প্রায় ১৭.৫ শতাংশ মানুষই ভারতের বাসিন্দা। শুধু তাই-ই নয়, পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষই বাস করে ভারত ও চিনে। ভারত ও চিন ছাড়া অন্যান্য জনবহুল দেশ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া এবং ব্রাজিল।
এ বার প্রশ্ন, জনসংখ্যার এই বিপুল চাপ কি আদতে কেবল বোঝা? এই প্রশ্নের উত্তরে ভারতের সমাজতাত্ত্বিকরা দু’ ভাগে বিভক্ত। এক দলের মতে— জনসংখ্যা বোঝা তো নয়ই, বরং সম্পদ। জনসংখ্যার উপরই নির্ভর করে যে কোনও দেশের সামগ্রিক উৎপাদন ও আর্থিক বুনিয়াদ। কাজেই কেবল জনসংখ্যার হার কমানোর উদ্যোগ না নিয়ে সরকারের উচিত জনগণকে বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে সামিল করা। সোজা কথায় , প্রত্যেক মানুষের যে কর্মক্ষমতা আছে, তাকে দেশের উন্নয়নের কাজে, উত্পাদনের কাজে ব্যবহার করতে পারলে, জনসংখ্যা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না।
জনসংখ্যার চাপ বোঝা যায় রোজের যানবাহনেই। ছবি: শাটারস্টক।
আবার আর এক দলের মতে, পৃথিবীর যা সম্পদ রয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ৩০০ কোটি লোককে জায়গা দেওয়া সম্ভব। তাই ধীরে ধীরে জনসংখ্যা কমিয়ে আনা উচিত। কেবল এ ভাবেই প্রকৃতির ওপর যে নির্যাতন চলছে তা বন্ধ করা যাবে, যা আসলে মানুষের ভবিষ্যতের পক্ষেও মঙ্গলজনক। সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায় এ ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থায় বিশ্বাসী। তাঁর মতে, “দেশের জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসাবে ব্যবহার করা যেমন সরকারের অবশ্যকর্তব্য, তেমনই মনে রাখতে হবে, জনগণকে কোনও প্রকল্প বা পরিকল্পনার অংশীদার করে তুলতে যে সময় প্রয়োজন, তত দিনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রতি যত্নবান না হলে, প্রাকৃতিক ও সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হবে।” তাই তাঁর মতে, “এক দিকে যেমন উৎপাদনের হার বাড়াতে হবে দেশের জনসংখ্যাকে ‘ক্যাপিটাল’ করেই, তেমনই তা যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না চলে যায় সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।” তাঁর মতে, কেবল উপযুক্ত শিক্ষাই নয়, তার পাশাপাশি কর্মসংস্থান ও স্বাবলম্বনের পাঠ শেখানোও প্রয়োজন। সন্তান উৎপাদনই যে জীবনের মূল লক্ষ্য নয়— এমন বার্তা ছড়িয়ে দেওয়াও বিশেষ প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: বহু বাধা পেরিয়ে উর্দুতে রামায়ণ অনুবাদ মুসলিম কন্যার
ট্রেনে-বাসে বাদু়ড়ঝোলার রোজনামচা। নিজস্ব চিত্র।
জনগণনার হিসেবকে সামনে রেখে আরও যে বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হওয়ার কথা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তা এই দেশে নারী-পুরুষ সংখ্যার বৈষম্য। ভারতে প্রতি ১০০০ জন পুরুষের নিরিখে মহিলার সংখ্যা ৯৪৩ জন। কন্যাভ্রূণ হত্যা, যা ভারতে কন্যা সন্তানের প্রতি অনীহারই ফসল, এর মূল কারণ বলে অনেক বিশেষজ্ঞের মত। আজও ভারতের বহু পরিবার কেবলমাত্র পুত্রসন্তান লাভের আশায় বারবার সন্তানবতী করে মহিলাদের। এরও বিপুল প্রভাব পড়ে জনসংখ্যায়। এই মানসিকতা রোধে সরকারের উপযুক্ত প্রয়াস ও প্রয়োজনে কড়া আইনি পদক্ষেপ করা প্রয়োজন বলেও তাঁদের মত।
তবে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবদানও অস্বীকার করা যায় না। বিভিন্ন উন্নত পরিষেবা, মারণরোগের নানা প্রতিষেধক আবিষ্কার ও গবেষণামূলক চিকিৎসার মাধ্যমে সারা পৃথিবীর সঙ্গে ভারতেও মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে একজন ভারতীয় পুরুষের গড় আয়ু বিগত দশ বছরে ৬৪ ভছর থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ বছরে। মহিলাদের হয়েছে ৬৮ থেকে ৭২। যা অত্যন্ত ইতিবাচক।
তাই সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, দেশকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছতে গেলে মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণও একান্ত প্রয়োজনীয়। উপযুক্ত শিক্ষার পরিকাঠাম, সচেতনতা ও বিপুল কর্মসংস্থানের মাধ্যমেই যা সম্ভব। তবেই এই বিশেষ দিনটিকে উপযুক্ত মর্যাদা দান সম্ভব।
আরও পড়ুন: ঋতুকালীন স্বাস্থ্যের পাঠ তথ্যচিত্রে