বিজয়িনী: শীর্ষ আদালতের রায়ের পরে উচ্ছ্বাস মহিলা সেনা অফিসারদের। রয়েছেন বিজেপি সাংসদ ও আইনজীবী মীনাক্ষী লেখি-ও। সোমবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই
চশমার পিছনের দু’টো চোখে খুশির ঝিলিক। মুখে সেনা অফিসারের পেশাদারি কাঠিন্য সরিয়ে চওড়া হাসি। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সীমা সিংহ হাসতেই হাসতেই বললেন, ‘‘আমরা তো সেনাবাহিনী ছাড়ছি না। সেনাবাহিনীই আমাদের ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল।’’
প্রায় দশ বছরের লড়াই। পুরুষদের মতোই পার্মানেন্ট কমিশন পেতে সীমা সিংহ যখন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, তখন তিনি মেজরের পদে। দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও সেনাবাহিনী তাঁকে পার্মানেন্ট কমিশন দিতে চায়নি। সেদিন শীর্ষ আদালতে মেজর সীমা বলেছিলেন, ‘‘আমরা লড়াইয়ের ময়দানে পুরুষদের মতোই কাজ করছি। কিন্তু মহিলা বলে সেনা পার্মানেন্ট কমিশন দিতে নারাজ।’’
আজ সেনাবাহিনীর সেই ‘বস্তাপচা’ মনোভাবের কড়া সমালোচনা করে বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি অজয় রাস্তোগির বেঞ্চ রায় দিল, কমান্ডিং অফিসারের পদ থেকে মহিলাদের বাদ রাখা চলবে না। সেনার যে সব মহিলা অফিসারদের শর্ট সার্ভিস কমিশনে ১৪ বছর চাকরি হয়ে গিয়েছে এবং যাঁরা এখনও চাকরি করছেন, তাঁদের সকলকেই পার্মানেন্ট কমিশনের জন্য বিবেচনা করতে হবে। পার্মানেন্ট কমিশনে গেলে তবেই কমান্ডিং অফিসারের পদ পাওয়ার সুযোগ থাকে। এখন যে ভাবে যোগ্যতা এবং শূন্যপদের ভিত্তিতে পার্মানেন্ট কমিশনে যাওয়ার অধিকার থাকে বায়ুসেনায়, সেই রীতি সেনাতেও বিবেচনা করতে বলেছে আদালত। সেই সঙ্গে পার্মানেন্ট কমিশনে যাওয়ার পরে কমান্ডিং অফিসারের পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে মহিলাদের যেন বাদ দেওয়া না হয়, সেটাও আদালতের নির্দেশ। তবে শেষ পর্যন্ত মহিলাদের কত জন পার্মানেন্ট কমিশনে যাওয়ার সুযোগ এবং পরবর্তীতে কমান্ডিং পদে যাওয়ার সুযোগ পাবেন, সেটা অবশ্য সেনাই ঠিক করবে।
মোদী সরকার সুপ্রিম কোর্টে যুক্তি দিয়েছিল, পুরুষ জওয়ানেরা মহিলা কমান্ডিং অফিসারদের নির্দেশ না-ও মানতে পারেন। সন্তানধারণ, মাতৃত্ব, পরিবার-সন্তানের প্রতি দায়িত্ব মহিলাদের কাজ আরও কঠিন করে তুলবে। উত্তরে বিচারপতি চন্দ্রচূড় তাঁর রায়ে বলেছেন, ‘‘এই বস্তাপচা মনোভাবের মূলে রয়েছে একটি সামাজিক ধারণা, যেখানে পরিবারের দায়িত্ব শুধুই মহিলাদের বলে মানা হয়। নারী ও পুরুষের মধ্যে ফারাক করা শুধু মান্ধাতার আমলের মানসিকতাই নয়, সাংবিধানিক বিচারেও ভুল। কারণ, সংবিধানে সরকারি চাকরিতে সমানাধিকারের কথা বলা রয়েছে।’’
২০১০-এ দিল্লি হাইকোর্টেরও রায় ছিল, সামরিক বাহিনীতে সমস্ত মহিলা অফিসারদের পার্মানেন্ট কমিশনের জন্য বিবেচনা করতে হবে। সেই রায়ের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে যায় কেন্দ্রীয় সরকার। আদালতে যান সীমারাও। এর পর ২০১৮-তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লাল কেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় সমস্ত মহিলা অফিসারদের পার্মানেন্ট কমিশন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। ২০১৯-এ কমব্যাট আর্ম বাদে সেনাবাহিনী ফৌজের ১০টি শাখায় মহিলাদের পার্মানেন্ট কমিশনের জন্য বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নেয় (আগে মাত্র দু’টি শাখায় মহিলাদের পার্মানেন্ট কমিশনের জন্য বিবেচনা করা হত)। একই সঙ্গে যাঁদের ১৪ বছর চাকরি হয়ে গিয়েছে, তাঁদের আর পার্মানেন্ট কমিশনের জন্য বিবেচনা করা হবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়। এ-ও স্থির হয়, পার্মানেন্ট কমিশন দেওয়া হলেও, মহিলাদের শুধু ‘স্টাফ’ বা সাধারণ অফিসার হিসেবেই নিয়োগ করা হবে। নেতৃত্ব বা কমান্ডিং অফিসার পদে নিয়োগ করা হবে না।
সেনাপ্রধান হবেন মেয়েরা?
না, সেনার শীর্ষ পদে মেয়েরা বসার অধিকারী নন এখনও। কারণ কমব্যাট আর্ম-সহ বেশ কিছু শাখায় মেয়েদের নিয়োগ করা হয় না। অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি লড়াইয়ে মেয়েরা এখনও ব্রাত্য। তবে সেই অধিকারও তাঁরা পাবেন না কেন, সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
রায়ে যা আছে
• দিল্লি হাইকোর্টের রায় বহাল সুপ্রিম কোর্টে। তিন মাসের মধ্যে রায় কার্যকর করার নির্দেশ
• সেনার কমান্ডিং অফিসার পদ থেকে মহিলাদের দূরে রাখা চলবে না
• যাঁরা শর্ট সার্ভিস কমিশনে চাকরি করছেন ও যাঁদের ১৪ বছর বা ২০ বছর চাকরি হয়ে গিয়েছে, তাঁদেরও পার্মানেন্ট কমিশনের জন্য বিবেচনা করতে হবে
• যাঁরা ১৪ বছর চাকরি করে ফেলেছেন কিন্তু পার্মানেন্ট কমিশনের জন্য আবেদন করেননি বা বিবেচিত হননি, তাঁদের ২০ বছর পর্যন্ত চাকরি করতে দিতে হবে যাতে পেনশন পান
• পার্মানেন্ট কমিশনের জন্য আবেদনের সময় পুরুষদের মতোই মহিলাদের সব সুযোগসুবিধা দিতে হবে
• মনে রাখতে হবে: সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ শুধু সেনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নৌসেনার ক্ষেত্রে মামলার শুনানি আজ সুপ্রিম কোর্টে
কেন? আদালতে প্রশ্নের মুখে মোদী সরকার সুপ্রিম কোর্টে যুক্তি দেয়, পুরুষ জওয়ানরা মহিলা কমান্ডিং অফিসারদের নির্দেশ না-ও মানতে পারেন। কারণ অধিকাংশ জওয়ানই গ্রাম থেকে আসেন। গ্রামে শহরের মতো ‘মুক্ত হাওয়া’ বয় না। তা ছাড়া সেনা অফিসারদের কাজ খুবই কঠিন ও নিয়মানুবর্তী। সন্তানধারণ, মাতৃত্ব ও পারিবারিক দায়দায়িত্বের কারণে মেয়েদের যে ছুটিছাটা নিতে হয়, অফিসার পদে সে সব চলে না। যে কোনও এলাকায় বদলি হওয়াটাও অসুবিধার। তার পরে মহিলা অফিসারেরা যুদ্ধবন্দি হলে সরকারের উপরে বাড়তি চাপ পড়বে।
আজ সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু কেন্দ্রের এই সব যুক্তি উড়িয়ে দিয়েছে। আদালতের নির্দেশ, যাঁদের শর্ট সার্ভিস কমিশনে ১৪ বছর চাকরি হয়ে গিয়েছে এবং যাঁরা চাকরি করছেন, সবাইকেই পার্মানেন্ট কমিশনের জন্য বিবেচনা করতে হবে। যাঁদের ১৪ বছর চাকরি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু পার্মানেন্ট কমিশনে নিযুক্ত হননি, এককালীন ব্যবস্থা হিসেবে তাঁদের ২০ বছর চাকরি করতে দিতে হবে, যাতে তাঁরা পেনশনের সুবিধা পান। যাঁরা পার্মানেন্ট কমিশন চাইছেন, তাঁদের পুরুষদের মতোই সমস্ত শাখায় দক্ষতা তৈরির সুযোগ ও সুবিধা দিতে হবে।
সেনার বিধি
শর্ট সার্ভিস কমিশন কী?
• শর্ট সার্ভিস কমিশনে সর্বাধিক ১৪ বছরের জন্য নিয়োগ করা হয়।
• পার্মানেন্ট কমিশন না দিয়েও কাউকে ২০ বছর পর্যন্ত চাকরিতে রাখা হয়, যাতে তিনি পেনশন ও অন্য অবসরকালীন সুবিধা পান।
মেয়েরা কী পেতেন?
• পার্মানেন্ট কমিশন দেওয়া হলেও কমান্ডিং অফিসার বা নেতৃত্বে বসানো হত না। শুধুমাত্র স্টাফ অফিসার হিসেবেই নিয়োগ করা হত।
• বায়ুসেনায় সমস্ত শাখাতেই মহিলাদের পার্মানেন্ট কমিশনের জন্য বিবেচনা করা হয়। এখন যুদ্ধবিমানের পাইলট হিসেবেও মহিলাদের নিয়োগ হচ্ছে
• নৌসেনার যে সমস্ত শাখায় অফিসারদের সমুদ্রে যেতে হয় না, সেখানে মহিলাদের শর্ট সার্ভিস কমিশনে নিয়োগ করা হয়। এডুকেশন, আইন, নেভাল কনস্ট্রাকটর, নেভাল আর্মামেন্ট শাখায় মহিলাদের পার্মানেন্ট কমিশনের জন্য বিবেচনা করা হয়।
• সেনার ১০টি শাখায় মহিলাদের শর্ট সার্ভিস কমিশনে নিয়োগ করে পার্মানেন্ট কমিশনের জন্য বিবেচনা করা হয়—জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল, এডুকেশন কোর, সিগনালস, ইঞ্জিনিয়ার্স, অ্যাভিয়েশন, এয়ার ডিফেন্স, ইলেকট্রনিক্স ও মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার্স, সার্ভিস কোর, অর্ডন্যান্স কোর, ইনটেলিজেন্স।
কোর্ট বলল
• মেয়েদের প্রতি বৈষম্য বস্তাপচা মানসিকতা।
• শারীরিক গঠন ও সামাজিক ধারণার ভিত্তিতে মহিলাদের ভূমিকা খাটো করে দেখানোর যুক্তি বিরক্তিকর। সংবিধান-বিরোধীও।
• পরিবারের দায়িত্ব শুধুই মহিলাদের, এই ধারণাটাই সন্তানধারণ, মাতৃত্ব,পরিবারকে মেয়েদের প্রতিবন্ধকতা বলে দেখে।
রায়ের পরে সুপ্রিম কোর্টে কার্যত উৎসবের মেজাজে হাজির লেফটেনান্ট কর্নেল সন্ধ্যা যাদব বলেন, ‘‘প্রায় এক দশকের লড়াই শেষ হল।’’ লেফটেন্যান্ট কর্নেল অঞ্জলি বিস্ত তাঁর স্বামী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনীশ থালপিয়ালের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে এসেছিলেন। বিস্ত বললেন, ‘‘আমাদের বৈষম্য ঘুচল। সেনার মতো কাজ করার জায়গা দুর্লভ। সে কারণেই আমরা সেনাবাহিনী ছাড়তে চাই না।’’
মহিলা অফিসারদের হয়ে লড়েছিলেন বিজেপি সাংসদ, আইনজীবী মীনাক্ষী লেখি। তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন। সেনা কর্তৃপক্ষই বিরোধিতা করছিলেন। আজ সেই বাধা দূর হয়ে গেল।’’ মোদীর ঘোষণার কথা স্মরণ করিয়ে আজকের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহও। তবে প্রধানমন্ত্রী চাইলে সেনা বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রক কী ভাবে সুপ্রিম কোর্টে উল্টো অবস্থান নিয়েছিল, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে। ঠিক যেমন প্রশ্ন উঠেছে রাহুল গাঁধীর মন্তব্য নিয়েও।
রাহুল আজ বলেন, ‘‘পুরুষদের তুলনায় নিকৃষ্ট বলে মহিলার অফিসাররা কমান্ডিং পদের যোগ্য নয় বলে কেন্দ্র দেশের সমস্ত মহিলাকে অসম্মান করেছে। রুখে দাঁড়ানোর জন্য ও বিজেপি সরকারকে ভুল প্রমাণ করার জন্য আমি মহিলাদের অভিনন্দন জানাই।’’ তার পরেই আইনজীবী নভদীপ সিংহ মনে করিয়ে দেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা মোদী জমানায় হয়নি। ২০১০-এ কংগ্রেস সরকারের আমলেই হয়েছিল।