National

কারা এই স্পেশ্যাল ফোর্স, কী কায়দায় এত নিখুঁত হামলা?

শত্রুর এলাকায় ঢুকে নিখুঁত অভিযান চালিয়ে এল যে স্পেশ্যাল ফোর্স, তাঁরা কারা? কেমন প্রশিক্ষণ হয় তাঁদের, অস্ত্রশস্ত্রই বা কী ধরনের? এত দুঃসাহসিক অভিযান কী ভাবে সম্ভব? জানাচ্ছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্তা।‘অন্ধকার আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং প্রতিপক্ষকে অবাক করে দেওয়া আমার সবচেয়ে বড় অস্ত্র।’ গভীর কৃষ্ণপক্ষের রাতের আড়াল ব্যবহার করে এবং পাকিস্তানকে অবাক করে দিয়ে সাতটা জঙ্গি ঘাঁটি যে ভাবে অত্যন্ত অল্প সময়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে এসেছে ‘স্পেশ্যাল ফোর্স’, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

Advertisement

কর্নেল সৌমিত্র রায়

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ২১:৩৬
Share:

প্যারা-কম্যান্ডোদের দক্ষতা এবং সক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিবরণ কখনোই প্রকাশ করে না সেনা। কার্যক্ষেত্রে বোঝা যায়, এই বাহিনী কতটা ভয়ঙ্কর। —ফাইল চিত্র।

‘অন্ধকার আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং প্রতিপক্ষকে অবাক করে দেওয়া আমার সবচেয়ে বড় অস্ত্র।’

Advertisement

এই কথাটা যে বাহিনীর মূল মন্ত্র, সেই বাহিনীই পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে অসামান্য আঘাতটা হানল। গভীর কৃষ্ণপক্ষের রাতের আড়াল ব্যবহার করে এবং পাকিস্তানকে অবাক করে দিয়ে সাতটা জঙ্গি ঘাঁটি যে ভাবে অত্যন্ত অল্প সময়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে এসেছে ‘স্পেশ্যাল ফোর্স’, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। কিন্তু সেনার কাছে এটা কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। স্পেশ্যাল ফোর্স এই জন্যই তৈরি করা হয়। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে শত্রুর এলাকায় ঢুকে তাদের অতর্কিতে বিধ্বস্ত করাই স্পেশ্যাল ফোর্সের প্রধান দক্ষতা।

স্পেশ্যাল ফোর্স বলে যে বাহিনীকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেই বাহিনীর নির্দিষ্ট নাম রয়েছে। কিন্তু কৌশলগত কারণে বাহিনীর পোশাকি নাম প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে এক কথায় জেনে রাখা ভাল, এই স্পেশ্যাল ফোর্সের প্রত্যেক সদস্য হলেন এক এক জন প্যারা-কম্যান্ডো। সেনাবাহিনীতে যে সাধারণ প্রশিক্ষণ হয়, এই প্যারা-কম্যান্ডোদের প্রশিক্ষণ তার চেয়ে অনেক উন্নত মানের এবং অনেক বেশি কঠিন। বিশেষ অভিযান এবং নিখুঁত অভিযানই এই বাহিনীর এক মাত্র কাজ। ভারতের স্পেশ্যাল ফোর্স নিজের কাজে যে কতটা দক্ষ, তা বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার ভোরের মধ্যে কয়েকটা ঘণ্টায় গোটা পৃথিবী দেখে নিয়েছে।

Advertisement

স্পেশ্যাল ফোর্সের অস্ত্রশস্ত্রও বাহিনীর অন্যান্য অংশের চেয়ে আলাদা। অপেক্ষাকৃত ছোট এবং হালকা অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে স্পেশ্যাল ফোর্স। কিন্তু সেই সব আগ্নেয়াস্ত্র উচ্চ মাত্রায় স্বয়ংক্রিয় এবং মারণ আঘাত হানতে সক্ষম। খুব গোপনে, অতর্কিতে এবং দ্রুত হামলা চালাতে হয় বলেই এই ধরনের অস্ত্র থাকে প্যারা-কম্যান্ডোদের কাছে। শোল্ডার লঞ্চড রকেট বা কাঁধ থেকে ছোড়ার মতো রকেটও থাকে এই প্যারা-কম্যান্ডোদের কাছে।

পাক অধিকৃত কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ২৫০ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এলাকায় যে ভয়ঙ্কর আঘাত হানল ভারত, তা কিন্তু অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল। মাত্র ১৫০ জনের উপর সাতটা লঞ্চ প্যাডে হামলা চালানোর দায়িত্ব ছিল। এই লঞ্চ প্যাডগুলো আসলে পাক সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ব্রিগেডের সদর দফতর। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের আরও অনেক ভিতরে জঙ্গিদের আসল ঘাঁটিগুলি রয়েছে। সেখান থেকেই লঞ্চ প্যাড বা পাক সেনার ব্রিগেড সদর দফতরে আসে জঙ্গিরা। সেখানে তারা ২৪ ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পায়। তার পর তাদের নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ভারতে ঢোকার নির্দেশ দেওয়া হয়। ভারতীয় বাহিনীকে ব্যস্ত রাখতে সাধারাণত এই সব অনুপ্রবেশের সময়ে পাক সেনা ভারী গোলাবর্ষণ শুরু করে। সেই সুযোগে বিভিন্ন এলাকা দিয়ে চার-পাঁচ জন করে জঙ্গির এক একটি দল ভারতে ঢুকে পড়ে। এ বার কিন্তু আরও অনেক বড় জঙ্গি অনুপ্রবেশের ছক কষেছিল পাকিস্তান। সাতটি লঞ্চ প্যাডে এক সঙ্গে জঙ্গিদের জড়ো করা হচ্ছিল। প্রতিটি ঘাঁটিতে প্রায় ৩০ জন করে জঙ্গি হাজির হয়েছিল। এদের এক সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকিয়ে দিয়ে সেখানে চরম উত্তেজনা ছড়ানোর ষড়যন্ত্র করেছিল পাকিস্তান। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে সে খবর পৌঁছে যায় আগেই। তাই সর্বক্ষণ গোপনে নজর রাখা হচ্ছিল লঞ্চ প্যাডগুলিতে। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছিল। স্পেশ্যাল ফোর্সের কয়েকজন কম্যান্ডো আগেই ওই সব সেক্টরে ঢুকে রেকি করে এসেছিলেন। কোথায় কত সেনা রয়েছে, কোন অঞ্চলে সার্চ লাইট রয়েছে, কোথায় শক্তিশালী দূরবীন লাগানো রয়েছে, সব খবর সংগ্রহ করা হয়েছিল। তার ভিত্তিতেই আক্রমণের রুট ঠিক করা হয়।

হেলিকপ্টারে করে কিন্তু ভারতীয় প্যারা-কম্যান্ডোরা পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ঢোকেননি। কপ্টার তাঁদের একটা নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। কিন্ত তা নিয়ন্ত্রণ রেখার খুব কাছাকাছি হওয়া সম্ভব নয়। কারণ হেলিকপ্টার নিয়ে ওই এলাকায় গেলে তা সহজেই পাক বাহিনীর নজরে পড়ে যেত। প্যারা-কম্যান্ডোদের প্যারাড্রপিং করা হয়েছিল এমন কোনও জায়গায়, যে এলাকা পাকিস্তানের নজরদারির বাইরে। সেখান থেকে রাতের অন্ধকারে পায়ে হেঁটেই পাকিস্তানে ঢুকে পড়ে ভারতের স্পেশ্যাল ফোর্স। খাড়াই পাহাড় এবং ঘন জঙ্গলে ঢাকা ওই এলাকা কিন্তু অত্যন্ত দুর্গম। রাতের অন্ধকারে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ২৫০ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এবং ওই দুর্গম পথ পেরিয়ে নির্দিষ্ট এলাকায় আঘাত হেনে রাত শেষ হওয়ার আগেই দেশে ফিরে আসা অত্যন্ত দুরূহ কাজ ছিল। সেই কাজটা খুব নিখুঁত ভাবে সেরে ফেলেছে ভারতীয় স্পেশ্যাল ফোর্স।

আরও পড়ুন: নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে হামলা ভারতের, বিধ্বস্ত ৭ জঙ্গি ঘাঁটি

প্রথম ধাপটির অর্থ হল নিঃশব্দে শত্রুর এলাকায় ঢুকে পড়া বা অনুপ্রবেশ করা। এই কাজটা করতেই সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে স্পেশ্যাল ফোর্সের। যে লঞ্চ প্যাডগুলিতে হামলা হয়েছে, সেগুলি নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে ২ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। সোজাসুজি সেখানে গেলে সময় অনেক কম লাগে। কিন্তু তা করা সম্ভব ছিল না। শত্রুর এলাকায় ঢুকে সামনাসামনি তাকে আক্রমণ করা অত কম সংখ্যক সৈনিকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অনুপ্রবেশের পথটা ছিল অনেক জটিল। পাক বাহিনী এবং গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে পড়েছিল স্পেশ্যাল ফোর্স। সেখান থেকে পিছন দিক দিয়ে লঞ্চ প্যাডগুলিতে হামলা চালানো হয়। আগেই বলেছি, এই স্পেশ্যাল ফোর্সের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল প্রতিপক্ষকে অবাক করে দেওয়া। প্রতিপক্ষ যে দিক দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার কথা ভাবতেই পারবে না, প্রতিপক্ষকে অবাক করে দিয়ে সেই দিক দিয়েই হামলা চালাতে হবে। ঠিক সেই কৌশলেই গভীর কৃষ্ণপক্ষের রাতের আড়াল ব্যবহার করে ঘুরপথে পিছন দিক দিয়ে লঞ্চ প্যাডগুলিতে হাজির হন ভারতীয় কম্যান্ডোরা।

এর পর অভিযানের দ্বিতীয় ধাপ— এগজিকিউশন বা রেইড। অর্থাৎ হামলা চালানো। অতর্কিতে হামলা চালায় ভারতীয় বাহিনী। খুব দ্রুত বিধ্বস্ত করে দেয় লঞ্চ প্যাডগুলিকে। বহু জঙ্গির মৃত্যু হয়।

অভিযানের তৃতীয় ধাপ হল এক্সফিল্ট্রেশন। অর্থাৎ শত্রুর এলাকা থেকে নিজের এলাকায় ফিরে আসা। সেই কাজটা করতে প্যারা-কম্যান্ডোদের খুব একটা সময় লাগেনি। কারণ ফেরার সময় আর ঘুরপথে ফিরতে হয়নি তাঁদের। ২ কিলোমিটার দূরেই নিয়ন্ত্রণ রেখা। জঙ্গি নিকেশ করেই ক্ষিপ্র গতিতে নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ফিরে এসেছে বাহিনী।

এত নিখুঁত ভাবে পরিকল্পনার রূপায়ণ করেছেন ভারতীয় প্যারা-কম্যান্ডোরা যে পাক সেনা যত ক্ষণে গোলাবর্ষণ শুরু করেছে, তত ক্ষণে ভারতের স্পেশ্যাল ফোর্স নিয়ন্ত্রণ রেখার এ পারে, নিরাপদ দূরত্বে। হতাশ পাক বাহিনী বেশ কয়েক ঘণ্টা দিশাহীন গোলাবর্ষণ চালিয়েছে। ভারতও পাল্টা জবাব দিয়েছে। কিন্তু তত ক্ষণে জঙ্গি ঘাঁটিতে হাহাকার। খেলা পাকিস্তানের হাতের অনেক বাইরে।

অনুলিখন: ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement