কঠিন শেষ ওভারে কি যুবরাজ সিংহ হয়ে ছয়ে ছক্কা হাঁকাতে পারবেন মোদী?—ছবি পিটিআই।
শেষ ওভার। ক্রিজে দাঁড়ানো ব্যাটসম্যান নরেন্দ্র মোদীর চোখ স্কোর বোর্ডে। কাজ কঠিন। ভোট প্রচারে রাহুল গাঁধীকে টেক্কা দিতে যুবরাজ সিংহের মতো ছয় হাঁকাতে হবে প্রতি বলে! লোকসভা নির্বাচনের মুখে শেষ ‘বাজেটে’র আগে প্রধানমন্ত্রীর সামনে পরিস্থিতি অনেকটা এ রকমই।
সকলের জন্য ন্যূনতম আয়ের যে প্রকল্প মোদীর তুরুপের তাস হতে পারত, রাহুল আগেভাগে সেই ঘোষণা সেরে ফেলেছেন। চাষিদের ক্ষোভের ক্ষতে মলম দিতে গেলেও টেক্কা দিতে হবে কংগ্রেসকে। যারা তিন রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই কৃষিঋণ মকুব করেছে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছে লোকসভা ভোটে জিতলে সারা দেশে তা করার। আগের বার বছরে দু’কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির মসনদ দখল করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু গত সাড়ে চার বছরে সম্ভব হয়নি তার ধারেকাছে পৌঁছনো। বরং নোটবন্দিতে কাজ খুইয়েছেন বহু জন। তা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেও কার্যত নাক কাটা গিয়েছে ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়া রিপোর্টে। এনএসএসও-র সমীক্ষা দেখিয়েছে, নোটবন্দির ঠিক পরেই ২০১৭-’১৮ সালে দেশে বেকারত্বের হার ছিল গত সাড়ে চার দশকে সর্বোচ্চ। তার উপরে তড়িঘড়ি জিএসটি চালুর ধাক্কায় এখনও ধুঁকছে ছোট-মাঝারি শিল্প। ক্ষুব্ধ বিজেপির বরাবরের বিশ্বস্ত ভোটব্যাঙ্ক ছোট ব্যবসায়ীরাও। রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় যা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এই অবস্থায় রাহুল গাঁধীর নাগাড়ে আক্রমণ আর আগাম প্রতিশ্রুতিতে ‘আস্কিং রেট’ এমনই চড়া যে, বল ছাড়ার বিলাসিতা তো দূর, ছ’বলে ছয় ছক্কা হাঁকাতে হবেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একে তো এমন প্রত্যাশা পূরণের বাজেট তৈরি করা শক্ত। বিশেষত যেখানে প্রত্যাশার পারদ আগেই এতটা চড়িয়ে রেখেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী। তার উপরে আবার শেষ বাজেটে রাজকোষ ঘাটতির ইয়র্কার অবধারিত ভাবে অপেক্ষা করবে মোদী সরকারের জন্য। এমনিতেই গত পাঁচ বার বাজেট পেশ করা অরুণ জেটলি বেশির ভাগ বছরই ঘাটতিকে লক্ষ্যে বাঁধতে পারেননি। এ বার চিকিৎসার জন্য তিনি বিদেশে। চাহিদা মেনে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের উইকেট নিয়ে যেতে পারে সেই ঘাটতির ইয়র্কারই। বৃদ্ধির গতি ৮% ছুঁতে পারেনি। জিএসটি থেকে আদায়ও প্রত্যাশার ধারেকাছে নেই। ফলে কেন্দ্র কল্পতরু হতে গেলেই প্রশ্ন উঠবে, টাকা আসবে কোথা থেকে? কোন জাদুতে এ বারের ঘাটতির লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জোগাড় হবে নতুন স্বপ্ন দেখানোর টাকা?
আরও পড়ুন: পুরনো রিপোর্ট বদলে গেল ১ শতাংশ বৃদ্ধির হারে, কী ভাবে সম্ভব? উঠছে প্রশ্ন
চোখ থাকবে কাজের সুযোগ তৈরির দিকেও। যে তরুণ প্রজন্মের ভোট মোদী টানতে চান, চাকরি নেই বলে তাঁদের ক্ষোভকেই লাগাতার উস্কে দিচ্ছেন রাহুল। হালে বেসুরো গাওয়া মোদী সরকারের মন্ত্রী নিতিন গডকড়ীও বলছেন, চাকরিই নেই তো উচ্চবর্ণের সংরক্ষণ! তা হলে বাজেটে কি কর্মসংস্থান বাড়াতে কোনও চমকপ্রদ ঘোষণা করবেন ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী? বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা অবশ্য এ প্রসঙ্গে নীরব। মধ্যবিত্তদের ক্ষোভে জল ঢালতে আয়কর ছাড়ের সীমা এবং করমুক্ত লগ্নির অঙ্ক বাড়ানোর জল্পনাও গত কিছু দিনে জোরালো হয়েছে ক্রমশ। সামান্য হলেও তাতে ঘি ঢেলেছে সংসদে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য।
এমনিতে বিরোধীরা হল্লা করতে পারেন আঁচ করে খাতায়-কলমে অন্তর্বর্তী বাজেট পেশের কথাই বলেছে কেন্দ্র। কিন্তু ভোট বছরে তা আদৌ হতে দেবেন মসনদে ফিরতে মরিয়া মোদী? অন্তর্বর্তী বাজেট হলেও তা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে হওয়া জরুরি বলে আগেই গেয়ে রেখেছেন জেটলি। বাজেটে নতুন চমক না দিলে, মোদীর সামনে পথ বলতে শুধুই প্রচারের ময়দান।
আরও পড়ুন: রাহুলের মোকাবিলায় কি যুবরাজ হতে পারবেন ‘ব্যাটম্যান’?
মোদী বরাবরই বিপণনে দড়। চমকে বিশ্বাসী। ভোটের বাজেটেও তাই করতে পারলে হয়তো খুশি হতেন তিনি। কিন্তু তাতে জল ঢেলে দিয়েছেন রাহুল। এখন ন্যূনতম আয়ের ঘোষণা করতে গেলেও তা রাহুলের নকল বলে কংগ্রেস কটাক্ষ করবে। প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনের হিসেব, গ্রামের ৭৫% পরিবারকে মাসে ১,৫০০ টাকা করে দিতে হলে বছরে লাগবে প্রায় ২.৬৪ লক্ষ কোটি টাকা। যা জিডিপির ১.৩%। খাদ্য-সার-জ্বালানির ভর্তুকি তুলে দিলেও সেই বোঝা কম নয়।
একই সমস্যা চাষিদের ক্ষোভের ক্ষতে মলম দেওয়ার ক্ষেত্রেও। জলের দরে ফসল বেচতে বাধ্য হওয়া চাষিরা ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। পায়ে দগদগে ঘা নিয়েও চাষিদের লং মার্চের ছবি এখনও টাটকা। কংগ্রেস কৃষি ঋণ মকুবের কথা বললেও মোদী মনে করেন তা সমস্যার সমাধান নয়। ফসলের এমএসপি (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য) খরচের দেড় গুণ করার কথা বলেও চাষিদের মন পায়নি কেন্দ্র। এই পরিস্থিতিতে বাজেটে তিন রকম রাস্তা খোলা। এক, এমএসপি-র সঙ্গে বাজারদরের ফারাক মিটিয়ে দেওয়া। দুই, চাষের মরসুমের শুরুতেই থোক টাকা সরাসরি চাষির অ্যাকাউন্টে দেওয়া। অনেকটা তেলঙ্গানায় রায়তু-বন্ধুর ধাঁচে। যাতে ধার করার প্রয়োজন কমে। আর তিন, ফসল বিমার প্রিমিয়ামের টাকা মিটিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে কেন্দ্র। কিন্তু এই তিন ক্ষেত্রেও প্রশ্ন টাকার জোগাড়ই।
রাজনৈতিক মহলের মতে সরকারের সমস্যা হল, এর সব কিছুই হয় কংগ্রেস ঘোষণা করেছে বা নানা রাজ্য করে রেখেছে। নয়তো আয়কর ছাড়ের মতো জল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে আগে থেকেই। ফলে সব করেও ‘এ আর এমনকি’ শোনার সম্ভাবনা ষোলো আনা। আবার সব প্রত্যাশা পূরণ করতে গেলে তাড়া করবে ঘাটতির ভূত।
প্রশ্ন হল, এই পরীক্ষা উতরোতে তবে কি ফের হিসেবের কারচুপি করে ঘাটতি কমিয়ে দেখাবে কেন্দ্র? ইতিমধ্যেই সিএজি জানিয়েছে, বাজেটের বাইরে গিয়ে টাকা জোগাড় করে ভর্তুকি দেওয়া ও ফসল কেনা হয়েছে। বিলগ্নিকরণের লক্ষ্য পূরণের জন্যও এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার অংশীদারি আর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে দিয়ে কিনিয়েছে সরকার।
এক দিকে, পাঁচ বছর আগে নিজের দেওয়া পাহাড়প্রমাণ প্রতিশ্রুতি। অন্য দিকে, তা পূরণ না হওয়া নিয়ে বিরোধীদের আক্রমণ। এক দিকে, পালে হাওয়া কেড়ে রাহুলের আগাম ঘোষণা। অন্য দিকে, তাকে ছাপাতে গেলে ঘাটতির চোখরাঙানি। এই কঠিন শেষ ওভারে কি যুবরাজ সিংহ হয়ে ছয়ে ছক্কা হাঁকাতে পারবেন মোদী?
অনেকে অবশ্য বলছেন, নিয়ম মেনে খেললে তো শেষ ওভারও খেলা হয়ে গিয়েছে আগেই। এ তো সেই পাড়ার ক্রিকেটে ‘আমার ব্যাট তাই আরও এক ওভার খেলব’ ধাঁচের গাজোয়ারি! কারণ, যে সরকারের মেয়াদ আর কয়েক মাস, বছরভরের বাজেট করার নৈতিক অধিকারই তার নেই। রাজনৈতিক ভাবেও তা অন্যায়।
মোদী তা হলে এখন কী করবেন? প্রশ্ন সেটাই।