মুজফফরপুরের হাসপাতালে ভর্তি শিশু রোগী। ছবি: এএফপি।
কেন এনসেফেলাইটিসে একের পর এক শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বিহারে? ইতিমধ্যেই ১২৬টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে মুজফ্ফরপুরে। এর কারণ কি সরকারি গাফিলতি? হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাব? নাকি রোগনির্ণয় বা রোগের কারণ নির্ধারণে কোনও ভুল থেকে যাচ্ছে?
বিশেষজ্ঞদের কেউ বলছেন, শিশুমৃত্যুর কারণ অপুষ্টি। কেউ বলছেন, লিচুর বিষ থেকেই এই ঘটনা ঘটছে। আবার কেউ বলছেন, তীব্র তাপপ্রবাহের জন্যই একের পর এক শিশুর মৃত্যু হচ্ছে বিহারে। তবে একটা ব্যাপারে সকলেই একমত, শিশুরা যে রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, তার নাম- 'অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিনড্রোম (এইএস)'। এখনও পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মুজফ্ফরপুরের শ্রীকৃষ্ণ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩০৬টি শিশু।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এইএস হতে পারে ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়ার হানাদারিতে। ছত্রাক বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরজীবী প্রাণীদের হঠাৎ আক্রমণে। অথবা কোনও রাসায়নিক বা বিষ শরীরে ঢোকার ফলে। তবে এইএস মানেই এনসেফেলাইটিস, তা মানতে রাজি নন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব পেডিয়াট্রিক্স (আইএপি)-এর প্রাক্তন সভাপতি ও ভেলোরের ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের এমেরিটাস প্রফেসর টি জে জন। তিনি জানাচ্ছেন, শিশুদের মস্তিষ্কের যে কোনও রোগকেই বলা হয় এইএস বা অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিনড্রোম। শিশুদের খিঁচুনি হলে বা তারা হঠাৎ অচৈতন্য হয়ে পড়লেও, অপ্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরা তাকে এইএস বলেন। কিন্তু সেটা এইএসের কোন রোগ, সেটা একমাত্র বুঝতে পারেন চিকিৎসকরাই, পরীক্ষানিরীক্ষার পর। তা এনসেফেলাইটিস হতে পারে। যা ভাইরাসের হানাদারির জন্য হয়। তার ফলে প্রদাহ (লক্ষণ, ফোলা, দাগ) হয় শিশুদের মস্তিষ্কে। হতে পারে মেনিনজাইটিস। মস্তিষ্ক (ব্রেন) ও মেরুদণ্ড (স্পাইনাল কর্ড)-এর বাইরে যে নিরাপত্তার আবরণী থাকে, তা ক্ষয়ে যেতে থাকে দ্রুত। এইএসের ফলে আরও দু'টি রোগ হতে পারে শিশুদের। এনসেফ্যালোপ্যাথি ও সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া। এনসেফ্যালোপ্যাথি হল সেই রোগ যার ফলে মস্তিষ্কের গঠন বা কাজকর্ম বদলে যায়। আর সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া হল সেই রোগ যার ফলে ম্যালেরিয়ার সঙ্গে সংক্রমণ ঘটিত স্নায়ুতন্ত্রে নানা রকমের জটিলতা দেখা যায়।
আরও পড়ুন- প্রস্তুতিতে খামতি ছিল, গঙ্গায় জাদুকরের মৃত্যু নিয়ে মত পি সি সরকারের
আরও পড়ুন- বিহারে শিশুমৃত্যু বেড়ে ৬৮
মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার মঙ্গলবার মুজফ্ফরপুরের হাসপাতালে গিয়ে অসুস্থ শিশুদের দেখে এসেছেন। গত রবিবার মুজফ্ফরপুরে ওই হাসপাতালে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হর্ষ বর্ধন। তিনিও বলেছেন, "রোগের আদত কারণ আগে খুঁজে বের করতে হবে।" দিল্লির ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (এনসিডিসি) ও আমেরিকার আটলান্টার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি)-এর বিশেষজ্ঞরা পাঁচ বছর আগেকার ঘটনার উপর গবেষমা চালিয়ে এই রোগের যে কারণের কথা জানিয়েছেন, তার সঙ্গে অবশ্য একমত হতে রাজি হননি দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ।
এনসিডিসি এবং সিডিসি গবেষণা চালিয়েছিল ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত। সেই গবেষণা থেকে তারা জানাচ্ছে, লিচুর বিষ থেকেই এই রোগের উৎপত্তি। ওই গবেষকদলের অন্যতম সদস্য চিকিৎসক বিপিন বশিষ্ঠ বলেছেন, "লিচুর বিষ বা আরও অন্য কারণ থাকতে পারে। তবে এই রোগের সঙ্গে লিচু চাষের সম্পর্ক রয়েছে।"
বিশিষ্ট ভাইরাস বিশেষজ্ঞ টি জি জনের মতে, বিহারে শিশুদের অপুষ্টির মাত্রা ভয়াবহ। রাজ্যের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ শিশু ভোগে অপুষ্টির সমস্যায়। তারা শুধু গাছ থেকে পেড়ে লিচু খায়। আর কোনও খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। লিচুর মধ্যে থাকে একটি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। যার নাম- 'মিথিলিন সাইক্লোপ্রোপিল-গ্লাইসিন (এমসিপিজি)'। এই রাসায়নিকই অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের মস্তিষ্কে নানা রকমের জটিলতার সৃষ্টি করে।
তবে এ বার সেই ধারণাটা বদলে গিয়েছে বলে দাবি করেছেন মুজফ্ফরপুরের শ্রীকৃষ্ণ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান চিকিৎসক গোপাল শঙ্কর। তাঁর কথায়, "তীব্র তাপপ্রবাহ ও কম বৃষ্টিপাতের মতো পরিবেশগত কারণেই এই শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২০০৫, ২০১১, ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৯, যে ক'বার বিহারে এমন রোগে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, দেখা গিয়েছে, প্রতি বারই তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ছিল একটানা, ওই সময়ে। তাপমাত্রা ছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি, আর্দ্রতাও ছিল ৫০ শতাংশের বেশি। এমন পরিবেশের জন্য শুধু ২০১৪ সালেই ৭০০-রও বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। বৃষ্টিপাতই এই রোগ কমাতে পারে।"
গোপাল শঙ্কর মানতে চাননি, লিচুর বিষ থেকেই এই রোগের উৎপত্তি। তাঁর বক্তব্য, "এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর কোনও শিশুকে আমি তলপেটের কোনও সমস্যায় ভুগতে দেখিনি। লিচুর বিষই যদি এই রোগের কারণ হত, তা হলে কিন্তু শিশুদের ভুগতে হত তলপেটের সমস্যায়।"