কী দোষ করেছি, বলছেন মর্মাহত বৃদ্ধ দৈতাপতি

খোলা নর্দমার মাঝে মাছি ভনভন গলিটা ধরে যত দূর হাঁটতে হয়েছে, বাড়ির ভিতরে এক তলার সরু দালানটাও প্রায় ততটা লম্বা। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে প্রশস্ত অন্দর মহলের চেহারাটা দেখে তাই খানিক তাজ্জবই হতে হল। সেখানেই গামছা পরে নিজের ঘরের চেয়ারে গুম হয়ে বসে এক বৃদ্ধ। কার্যত তাঁকে ঘিরে তোলপাড়ে শুধু এই জগন্নাথ ধাম নয়, গোটা ওড়িশার রংটাই গিয়েছে বদলে।

Advertisement

ঋজু বসু

পুরী শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৫ ০৩:০৩
Share:

জগন্নাথ সোয়াঁইন মহাপাত্র এবং কাশীনাথ দাস মহাপাত্র

খোলা নর্দমার মাঝে মাছি ভনভন গলিটা ধরে যত দূর হাঁটতে হয়েছে, বাড়ির ভিতরে এক তলার সরু দালানটাও প্রায় ততটা লম্বা। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে প্রশস্ত অন্দর মহলের চেহারাটা দেখে তাই খানিক তাজ্জবই হতে হল।

Advertisement

সেখানেই গামছা পরে নিজের ঘরের চেয়ারে গুম হয়ে বসে এক বৃদ্ধ। কার্যত তাঁকে ঘিরে তোলপাড়ে শুধু এই জগন্নাথ ধাম নয়, গোটা ওড়িশার রংটাই গিয়েছে বদলে।

রাজ্যের বর্তমান শাসক দল বিজেডি-ঘনিষ্ঠ সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধের নাম কাশীনাথ দাস মহাপাত্র, হপ্তাদুয়েক আগে মন্দিরে পুরনো থেকে নতুন বিগ্রহে ঘট-পরিবর্তনের লগ্নে গর্ভগৃহে ঢুকে যিনি ‘ব্রহ্ম দর্শন’-এর জেদ ধরেছিলেন।

Advertisement

সেই জেদের ধাক্কাতেই অশান্তির মেঘ ঘনিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের সুখের সংসারে। মানুষের ভাবাবেগে ঘা-লাগার কথা বলে চলছে বিরোধী দলগুলির তর্জন-গর্জন।

মন্দিরের পোড়খাওয়া দৈতাপতি বা জগন্নাথ-সেবায়েত কাশীনাথ নিজেও কম অপমানিত হননি। গুপ্ত রীতির সময়ে ‘গর্হিত আচরণের’ জেরে নানা মহলে তিনি ধিকৃত হয়েছেন। নবকলেবরের গুরুত্বপূর্ণ আচারে বাধা সৃষ্টি করার অভিযোগে সরকারি তদন্তের পরে কাশীনাথ ও তাঁর পুত্র জয়কৃষ্ণকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।

রবিবারের সকালে সেই যন্ত্রণাই বিদ্ধ করছিল বৃদ্ধকে। ‘‘শরীরটা ভাল নেই, মাথা ঘুরছে’’— বলতে বলতে মনের কষ্ট উগরে দিচ্ছেন কাশীনাথ। আপন মনেই বিড়বিড় করছেন, ‘‘আমি কী অন্যায় করেছি! সারা জীবনটা মন্দিরে কাটল। এই ৭০-৮০ বছরে ব্রহ্মকে চাক্ষুষ করতে চাওয়ায় কোনও দোষ নেই!’’

পুরীর জগন্নাথ ধামে এই ‘ব্রহ্ম দর্শনের’ অধিকার অবশ্য এখন রীতিমতো কাগজে-কলমে নথিবদ্ধ করেছে ওড়িশা সরকার। এই ‘রেকর্ড অব রাইট্‌স’-এ বলা আছে— মন্দিরের তিন বিগ্রহ ও জগন্নাথের অস্ত্র সুদর্শনের পুরনো থেকে নতুন বিগ্রহের ভিতরে ‘ব্রহ্ম’কে স্থাপন করবেন কোন চার জন দৈতাপতি।

কাশীনাথ বলছিলেন, ‘‘ওই চার জন দৈতাপতি বা বড়গ্রাহীরা তো মনিটর। আমরা প্রবীণ দৈতাপতিরা কেউ নই? ‘রেকর্ড অব রাইট্‌স’-এ এ কথাও লেখা আছে— অন্য মানে উপস্থিত থাহি পারন্তি ও কাম করন্তি (বাকি দৈতাপতিরা উপস্থিত থাকবেন ও কাজ করবেন)।’’

মন্দিরের মুখ্য প্রশাসক তথা আইএএস কর্তা সুরেশ মহাপাত্র অবশ্য এই ‘পারন্তি-করন্তি’-র দাবি মানতে নারাজ। তিনিই সপুত্র কাশীনাথের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। ঘট-পরিবর্তনের রাতে অন্য আচার অনুষ্ঠানে দেরি নিয়ে কিছু অভিযোগও উঠে আসছে। সরকারি কর্তা সুরেশ মহাপাত্রের সাফ কথা— ‘‘গুপ্ত রীতির সময়ে ভিতরে থাকতে চেয়ে দৈতাপতি কাশীনাথ ঠিক করেননি। বাবার পক্ষ নিয়ে কাশীনাথের ছেলেও ব্রহ্ম পরিবর্তনের দায়িত্বে থাকা বড়গ্রাহীদের সঙ্গে অভব্য ব্যবহার করেছেন।’’

মুখ্য দৈতাপতি, যিনি জগন্নাথের ব্রহ্ম পরিবর্তন করেন, সেই জগন্নাথ সোয়াঁইন মহাপাত্রও কাশীনাথ ও তাঁর পুত্রের আচরণে মর্মাহত। বলছেন, ‘‘এই জেদ তো পাগলামি! বংশপরম্পরা মতে বড়গ্রাহীরাই ব্রহ্ম পরিবর্তনের সময়ে ভিতরে থাকতে পারেন। কিন্তু প্রবীণ দৈতাপতি হিসেবে ওঁকে (কাশীনাথ) আমরা ব্রহ্ম পরিবর্তনের রীতি সম্পন্ন করেই ভিতরে ডেকে নিই!’’

তাতে কাশীনাথের ক্ষোভ কমছে না। নিজের জ্ঞাতিভাই অন্য দৈতাপতিদের বিরূপ আচরণে ব্যথিত হয়ে বলছেন— ‘‘যা প্রীতি সোদরে নাস্তি, তা প্রীতি ইতর জনে? নিজের ভাইকে না-ভালবাসলে সাধারণ ইতর জনকে কী ভাবে ভালবাসবেন!’’

কাশীনাথের দাবি, ‘‘বরাবরই ঘট-পরিবর্তনের সময়ে কয়েক জন প্রবীণ দৈতাপতি ভিতরে থাকেন। আমার বাবাও ছিলেন!’’ থেমে থেমে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে কথা বলার ফাঁকে পুরনো একটা জাব্দা খাতা বার করে বৃদ্ধ দেখাচ্ছেন, বাবার পুরনো ছবির কাটিং। তলায় ইংরেজিতে লেখা— ‘অধর দাস মহাপাত্র (৮২), ট্রান্সফার্ড ব্রহ্ম’!

বাস্তবিক, ব্রহ্ম প্রতিস্থাপন বা দর্শনের কৌলীন্যের গৌরবটুকু যেন জগন্নাথদেবের শবরভাই— দৈতাপতিদের আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। নবকলেবর সম্পূর্ণ হওয়ার আগে প্রভু দেড় মাস অসুস্থ থাকেন। মন্দিরের ভিতরে রুপোর দরজার কিনারে ‘অনশর পেন্ডি’-তে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দিনেও কিছু ঠাহর করা কঠিন। সেখানেই ব্রহ্ম পরিবর্তন হয়। ব্রহ্মের সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেন খোদ বড়গ্রাহীরাও। হাত কাপড়ে মুড়ে ও চোখের উপরে পাতলা পর্দা রেখে ব্রহ্ম পরিবর্তনই নিয়ম। কিন্তু ওই আবছায়ায় ব্রহ্মের অবয়ব দর্শন বা তাঁকে স্পর্শ করার অনুভূতি ‘জন্ম-জন্মান্তরের অভিজ্ঞতা’ বলে থাকেন ভাগ্যবান দৈতাপতিরা।

ভক্তদের মধ্যেও ব্রহ্মচন্দন বা ব্রহ্মকে মুড়ে রাখার কাপড়, ফুল, কস্তুরির ভাগ পাওয়ার অসীম আকুতি। সেই ‘পবিত্র’ বস্তু অনেক ভক্তই বাড়ির ঠাকুরঘরে রাখেন। দৈতাপতিরা তাঁদের আশা পূরণ করেন।

বড়গ্রাহীরা দাবি করছেন, বিবাদে সময় নষ্ট হলেও এ বার ব্রহ্ম পরিবর্তনের সময়ে ভিতরে তাঁরা ছাড়া কেউ ছিলেন না। কিন্তু কাশীনাথও বলে চলেছেন, ব্রহ্ম দর্শনের অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা! ‘‘নাঃ, এর পরে আমার আর কোনও জাগতিক চাহিদা নেই!’’

নবকলেবর-ধারণের এই কাউন্টডাউন-পর্বে গোটা পুরী মেতে আছে রথ-নির্মাণ থেকে উত্সবের প্রস্ততিতে। কিন্তু প্রভুর সেবা তো দূরে থাক, মন্দিরে ঢোকাই নিষেধ পোড়খাওয়া দৈতাপতি কাশীনাথের। ঢুকতে গেলে, ফৌজদারি মামলা হতে পারে বলে যেতে পারছেন না। তা ছাড়া, এমনিতেই উত্তপ্ত রাজ্যে ফের কী ঝামেলা হয়, কে বলতে পারে!

‘ব্রহ্ম-দর্শনে’র খেসারত এ ভাবে দিতে হবে মানতে কষ্ট হচ্ছে বৃদ্ধের। ‘‘কলিযুগে অভিমান, কষ্ট এ সব তো থাকেই!’’— এই বলেই মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন কাশীনাথ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement