নাবালক ধর্ষকের মুক্তির প্রতিবাদ মিছিলে নির্ভয়ার মা। রবিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: এএফপি
সন্ধে নামছে রাজধানীতে। কড়া হচ্ছে শীত। ইন্ডিয়া গেটের অদূরে ভিড়টা তখনও রাস্তা জুড়ে বসে। ওই ভিড়ের মধ্যেই হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে প্রৌঢ় বললেন, ‘‘আপনারা এত চেষ্টা করলেন। তবু ‘জুভেনাইল’ ছাড়া পেয়ে গেল। খুব দুঃখের কথা!’’ ভিড় থেকে আওয়াজ উঠল, ‘‘শেম শেম!’’
কথার মাঝেই থমকে গেলেন প্রৌঢ় বদ্রী সিংহ পাণ্ডে— তিন বছর আগে দিল্লির চলন্ত বাসে ধর্ষিতা নির্ভয়ার বাবা। একটু আগে তাঁর স্ত্রী আশা সিংহ বলেছেন, ‘‘আমার মেয়ের মৃত্যুর পর ভেবেছিলাম প্রশাসনিক ব্যবস্থা বদলাবে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সব কিছু ব্যর্থ হল।’’ ইন্ডিয়া গেট সংলগ্ন রাজপথ তখন মনে পড়াচ্ছে ২০১২-র ২২ ডিসেম্বর। নির্ভয়ার ধর্ষণের প্রতিবাদ ও কঠোর আইনের দাবিতে আছড়ে পড়া বিক্ষোভৃ ঠেকাতে তিন বছর আগে ওই দিনেই রাজপথে জলকামান আর কাঁদানে গ্যাস চালিয়েছিল প্রশাসন। আজও পায়ে পায়ে প্রতিবাদ এসে পৌঁছল ইন্ডিয়া গেট চত্বরে। হাতে হাতে পোস্টার, গলায় স্লোগান, অবস্থান-বিক্ষোভ, পুলিশি বাধা।
খবরটা যদিও অনেক আগেই এসে গিয়েছে— সাজা খেটে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে ‘জুভেনাইল’! বদ্রী-আশার মেয়ের উপর সব চেয়ে বেশি অত্যাচার চালিয়েছিল যে। ধর্ষণের পর শরীরের ভেতর থেকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সেই ‘জুভেনাইল’— নাবালক!
অপরাধের সময়ে বয়স আঠারো পেরোয়নি। তাই আইন মোতাবেক তার আসল নাম কোনও দিনই প্রকাশ করেনি পুলিশ-প্রশাসন। গত তিন বছর ধরে দেশ তাকে চিনেছে নির্ভয়ার ‘নাবালক ধর্ষক’ হিসেবে। ঠিক একই ভাবে আজও প্রকাশ করা হয়নি, মুক্তির পর তাকে কোথায় পাঠানো হল। দিল্লির যে সংশোধনাগার ছিল তার এত দিনের ঠিকানা, সেখান থেকেও গত কাল গোপনে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নির্ভয়ার ধর্ষককে। বলা হয়েছিল, তার নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত। আজ শুধু এটুকুই জানা যায়, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে একুশ বছরের ওই সদ্য-যুবককে তুলে দিয়েছে প্রশাসন। গোপন ঠিকানায় রাখা হয়েছে তাকে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তার অপরাধের ফাইল। এবং ভবিষ্যতেও তার পরিচয় গোপনই থাকবে।
নির্ভয়ার অন্য ধর্ষকেরা যখন মৃত্যুদণ্ড পাচ্ছে, তখন সব চেয়ে নৃশংস ধর্ষক (অন্য ধর্ষকদের বয়ান তেমনই বলছে) মাত্র তিন বছর হোমে থেকে ছাড়া পেয়ে যায় কী করে— এই প্রশ্ন নিয়েই এত দিন কাটাছেঁড়া চলেছে নানা মহলে। তার মুক্তি আটকাতে নির্ভয়ার বাবা-মা কেন্দ্রের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কেন্দ্র যায় দিল্লি হাইকোর্টে। কিন্তু হাইকোর্ট জানিয়ে দেয়, নাবালক আইনের সর্বোচ্চ সাজা খাটা হয়ে গিয়েছে ওই ধর্ষকের। আইনের বাইরে যাওয়ার এক্তিয়ার আদালতের নেই।
তখন থেকেই চলছিল ইতস্তত প্রতিবাদ সভা। গত রাতে নাটকীয়তা চরমে ওঠে দিল্লির মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন স্বাতী মালিওয়াল সটান দেশের প্রধান বিচারপতির বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ায়। ‘নাবালক ধর্ষকে’র মুক্তির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি। প্রধান বিচারপতির নির্দেশে গভীর রাতে বিচারপতি এ কে গয়ালের বাড়িতে বসে আদালত। বিচারপতি গয়াল এবং বিচারপতি ইউ ইউ ললিতের বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, মুক্তির নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে মামলার গুরুত্ব বুঝে সোমবার মামলাটির শুনানি হবে সুপ্রিম কোর্টে।
তবে সেই শুনানিতে যে তাঁদের তেমন আস্থা নেই, আজ পথে নেমেই জানিয়ে দিয়েছেন নির্ভয়ার মা। বলেছেন, ‘‘সবাই জানত ওকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তা হলে তিন বছর ধরে আটকানোর কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি কেন? আমাদের তো একটাই লড়াই ছিল, যাতে ওকে মুক্তি না দেওয়া হয়। যদি সে বেরিয়েই আসে, তা হলে আর শুনানির কী মানে!’’
এই প্রশ্নটাই আজ বারবার তুলেছে ইন্ডিয়া গেটের জমায়েত। নির্ভয়ার বাবা-মায়ের সঙ্গেই আওয়াজ তুলেছে, ‘আমরা হেরে গেলাম।’ পোস্টার লিখেছে, ‘নির্ভয়া সুবিচার চায়, নির্ভয়া আমারও মেয়ে!’ রবিবারের সকালে দিল্লির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নির্ভয়ার জন্যই মানুষ এসেছে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। সময় গড়িয়েছে, বেড়েছে ভিড়। জমায়েতের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল যন্তর-মন্তরে। তবে ‘জুভেনাইল’-এর মুক্তির খবর পেয়েই সেখান থেকে ইন্ডিয়া গেটের দিকে রওনা হয় মিছিল। মিছিলে ছিলেন নির্ভয়ার বাবা-মা।
ঠেকে শেখা প্রশাসন আর কোনও ঝুঁকি নেয়নি। এক সময়ে নির্ভয়ার বাবা-মা-সহ বেশ কয়েক জন বিক্ষোভকারীকে একটি বাসে তুলে পার্লামেন্ট স্ট্রিট থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। একটু পরেই অবশ্য ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁদের। যদিও তার মধ্যেই অভিযোগ ওঠে, পুলিশের ঠেলাঠেলিতে আহত হয়েছেন নির্ভয়ার মা। আবার পুলিশের বক্তব্য, ইন্ডিয়া গেটে ১৪৪ ধারা জারি থাকে। সেখানে বিক্ষোভ-মিছিল করা যায় না। বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা যে ভাবে বাড়ছিল, তাতে অনভিপ্রেত কিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই এলাকা খালি করে দেওয়া হয়।
নির্ভয়ার মা বলছিলেন,‘‘আমি তো আইনি লড়াইটাই লড়তাম। যখন দেখলাম সুবিচার পাব না, তখন জনতার মাঝখানে এলাম।’’ অসন্তোষ গোপন করেননি বিশেষজ্ঞদের অনেকেও। ‘সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চ’-এর ডিরেক্টর রঞ্জনা কুমারী বলেছেন, ‘‘আজ দেশের মহিলাদের দুঃখের দিন। ধর্ষণ এবং হত্যা কোনও নাবালকোচিত অপরাধ নয়। যদি ঘটনাটি ব্যতিক্রমী হয়, তা হলে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনেরও ব্যতিক্রমী পথ নেওয়া উচিত ছিল।’’ ‘ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান উইমেন’-এর সাধারণ সম্পাদক অ্যানি রাজার মতে, ‘‘সম্ভবত সব থেকে বেশি অপরাধ করে সবচেয়ে কম শাস্তি পেল এই ছেলেটি।’’
স্বাতী মালিওয়াল অবশ্য এ দিন টুইটারে লিখেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের কাছে অনেক আশা রয়েছে।’ তবে অনেকেরই আশঙ্কা, ব্যাপারটা নিছক নিয়মরক্ষা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই শুনানি ঘিরেও চলেছে রাজনীতির চাপান-উতোর। বিজেপির দাবি, মহিলা কমিশনের নেপথ্যে থেকে প্রচার পেতে চাইছেন অরবিন্দ কেজরীবাল। যদিও ইন্ডিয়া গেটে আজ বিজেপির ছাত্র শাখা এবিভিপি-র সদস্যরাও ছিলেন। যা দেখে আপ শিবিরের কেউ কেউ বলছেন, ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে বিজেপি। নির্ভয়ার বাবা-মা জানিয়েছেন, গোটা বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করার সময় চাইবেন তাঁরা।