সংসদে পেশ হওয়া তিন তালাক প্রথা বিরোধী আইন নিয়ে সাপ মেরে লাঠি না ভাঙার নীতি নিল তৃণমূল কংগ্রেস। বুধবার বীরভূমের আমোদপুরে এক সরকারি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মুসলিম মহিলাদের পাশে থাকার কথা ভেবে আমরা তিন তালাক বিলের বিরোধিতা করিনি। কিন্তু বিজেপি সরকার যে ভাবে ভুল পদ্ধতিতে বিল এনেছে, তা আমরা সমর্থন করছি না।’’
রাজ্যসভায় এ দিন তৃণমূলের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। সোমবার লোকসভায় তিন তালাক নিয়ে আলোচনায় অংশ নেয়নি তৃণমূল। ভোটাভুটিতেও চুপ ছিল দল। অথচ এ দিন রাজ্যসভায় বিলটি পাশ করিয়ে নেওয়ার পথে কার্যত প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ালো তৃণমূলই। দুই সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন এবং সুখেন্দুশেখর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস-সহ অন্যান্য বিরোধী দলকে পাশে নিয়ে তৃণমূল রাজ্যসভায় সোচ্চার হয় বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর জন্য। এই নিয়ে রাজ্যসভায় ভোটাভুটিও দাবি করা হয়। উত্তপ্ত আবহাওয়ায় অধিবেশন মুলতবি করে দেন ডেপুটি চেয়ারম্যান পি জে কুরিয়ান।
দুপুরে বীরভূমের আমোদপুরে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তিন তালাক বিল নিয়ে সংসদে ‘উপযুক্ত’ অবস্থান নেবে তাঁর দল। আপাতত তাদের কৌশল হল, লোকসভায় সংখ্যার জোরে বিজেপি এই বিল পাশ করিয়ে নিলেও রাজ্যসভায় তা আটকে দেওয়া। এবং আটকে দেওয়ার অজুহাত হিসেবেই সরাসরি বিলের বিরোধিতা না করে পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা বলতে চায় তৃণমূল।
কিন্তু সংসদের দুই কক্ষে তৃণমূলের দু’রকম ভূমিকা কেন? রাজ্যসভার সাংসদ সুখেন্দুশেখর বলেন, ‘‘যেহেতু লোকসভায় বিরোধীরা সংখ্যালঘু, তাই ওখানে সোচ্চার হয়ে কোনও লাভ ছিল না। চুপ করে থাকাটাই ছিল শ্রেয়। কিন্তু রাজ্যসভায় সরকারপক্ষ সংখ্যালঘু। এটাই সেরা জায়গা মোদী সরকারকে চেপে ধরার।’’ দলের অন্দরমহলে অবশ্য বিশ্লেষণ অন্যরকম। লোকসভায় ভোটাভুটির সময় চুপ করে বসে থাকার ফলে তৃণমূল বিলটিকে কার্যত সমর্থন করছে বলে ‘ভুল’ বার্তা যাচ্ছিল। সেই ‘ত্রুটি’ শুধরে নিতেই রাজ্যসভায় তারা অতিমাত্রায় সক্রিয় হল।
এই বিলের সমালোচনা করার ফলে সমাজে একাংশ যাতে ভুল না বোঝে সে কথা মাথায় রেখে মুখ্যমন্ত্রী এদিন জানান, সতীদাহ প্রথা রদ, বাল্য বিবাহ বন্ধ কিংবা বিধবা বিবাহ চালুর মতো ঘটনা বাংলা থেকেই শুরু হয়েছে। ফলে বাংলার মাটি আসলে ঐতিহাসিকভাবেই সমাজের বহমান সংস্কারের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাঁর সরকার কী ভাবে মহিলাদের ক্ষমতায়ন করেছেন তারও বহু উদাহরণ দেন মুখ্যমন্ত্রী।
মমতার কথায়, ‘‘বিজেপি ভুল বিল এনে মুসলিম মহিলাদের সংরক্ষণের বদলে তাঁদের সমস্যায় ফেলার ব্যবস্থা করছে।’’ কী সেই ভুল? মমতার মতে, এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে আইন পাশ করানোর আগে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার প্রয়োজন ছিল। এছাড়া বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের সঙ্গেও আলাদা করে কথা বলতে হত কেন্দ্রকে। সহমত হলে তবেই আইন করার ব্যাপারে এগনো উচিৎ ছিল দিল্লির। সে সব না করে যে ভাবে তালাক বিল বিরোধী বিল এসেছে তা কার্যত ‘চুলকে ঘা করার’ সামিল বলে মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী।
পাশাপাশিই মু্খ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সংস্কারের নামে ধর্মীয় অনুশাসনে হস্তক্ষেপ করা যায় না। যদি সংস্কার করতেই হয়, তা হলে সেই ধর্মের ভিতর থেকেই তা আসতে হবে। কোনও প্রথা যদি বরাবর মুসলিম সমাজে চলে আসে, তাতে সরকারের হস্তক্ষেপ করার কিছু নেই। তাই বিজেপি মুসলিম মহিলাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আসলে সমাজকে ভাঙার খেলায় নেমেছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের পাল্টা প্রতিক্রিয়া, ‘‘উনি তিন তালাক নিয়ে ঝেড়ে কাশুন। শ্যাম ও কুল দুই রাখার নীতি নিলে তো চলবে না!’’
তৃণমূলের তালাক-অবস্থানের সঙ্গে অবশ্য জিএসটি বিলের মিল পাওয়া যাচ্ছে। নীতিগতভাবে তৃণমূল জিএসটি চালুর পক্ষে ছিল। আইন পাশ হওয়ার সময় মোদী সরকারকে সমর্থনও দিয়েছিল। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে বিল পাশের জন্য জিএসটির বিরোধিতা এখনও করে চলেছে মমতার দল।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে এ দিন লোকসভাতেও ওবিসি-বিল নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে তৃণমূল। দলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ওবিসি কমিশন বিল নিয়ে আলোচনায় বলেন, ‘‘বিজেপি বলে থাকে মোদী আসার পরই ওবিসি-দের জন্য কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু এটা মিথ্যা প্রচার। মন্ডল কমিশন গঠনের সময় থেকেই এই কাজ শুরু হয়েছে।’’ তাঁর কথার মধ্যেই বিজেপি সাংসদরা চিৎকার করতে থাকেন। তৃণমূলও সমস্বরে পাল্টা চিৎকার করতে থাকে, ‘গুন্ডাগর্দি বন্ধ করো।’ হট্টগোল চরমে উঠলে লোকসভাও দিনের মতো মুলতবি হয়ে যায়।