নিহত পূরবীদেবীর ছবির সামনে স্বামী ও ছেলে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
লোহার বলের মতো কিছু একটা আচমকাই জানলা দিয়ে বাসের মধ্যে ছুড়ে দিয়ে ছুট দিয়েছিল কিশোরটি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কান ফাটানো শব্দে বিস্ফোরণ। তার পর ধোঁয়া আর গোঙানির শব্দ।
১৩ বছর আগের ঘটনা বলতে গিয়ে বুধবার চোখ চিকচিক করছিল দমদম পার্কের সুবীর মজুমদারের। ২০০৬ সালের জুলাইয়ে কাশ্মীরে লালচকের মোড়ে বাসের ভিতরে জঙ্গিদের ছুড়ে দেওয়া গ্রেনেডে সাত জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুবীরবাবুর স্ত্রী পূরবী এবং দিদি বন্দনা হালদারও। বন্ধু ও আত্মীয়দের নিয়ে অমরনাথ যাত্রায় যাচ্ছিলেন সুবীরবাবু।
মঙ্গলবারের হামলার প্রসঙ্গ তুলতেই চোয়াল শক্ত হয় ৬৮ বছর বয়সি বৃদ্ধের। নিজেকে সামলাতে সামলাতে বৃদ্ধ তোপ দাগেন ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের বিরুদ্ধে। বলে ওঠেন, ‘‘যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ— এ সবই ব্যবসা। অনেক উঁচু পর্যায়ের খেলা। চোখের সামনে আমার স্ত্রী, দিদি মারা গিয়েছিল সেই ঘটনায়। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাঁর স্ত্রী শেষ হয়ে গেল। মন শক্ত করে দিল্লি থেকে কফিনবন্দি দেহ নিয়ে কলকাতায় ফিরেছিলাম।’’
গত ১৩ বছরে দমদম পার্কে বহু পুরনো বাড়ি ভেঙে গড়ে উঠেছে নতুন বহুতল। প্রচুর নতুন মানুষ। তাই সুবীরবাবুর ফ্ল্যাটের মতো, পাড়ার পুরনো লোকজনদের সাহায্যেই খুঁজে পাওয়া গেল সুবীরবাবুর বন্ধু, ওই ঘটনায় মৃত আশিস ঘোষরায়ের বাড়িও। জিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অন্যতম অধিকর্তা তথা ভূকম্প-বিশেষজ্ঞ ছিলেন আশিসবাবু। স্ত্রী কাবেরী, শাশুড়ি, শ্যালক নিয়ে কাশ্মীর গিয়েছিলেন। হামলায় সকলেই মারা যান। বাসের চালকের পাশের আসনে ভাগাভাগি করে বসেছিলেন আশিসবাবু ও সুবীরবাবু। আশিসবাবুর দুই ছেলে এখন কলকাতার বাইরে থাকেন। ভাই অসীম ঘোষরায়ের কথায়, ‘‘পুরনো কথা মনে করলে শুধু কষ্ট আর কষ্ট, আর কী-ই বা আছে।’’
একই কারণে স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে প্রথমে কথা বলতে চাননি সুবীরবাবুও। কিছু পরে বললেন, ‘‘পহেলগাঁওয়ের পথে রওনা দিয়েছিলাম আমরা। লালচক ছেড়ে সামান্য এগোতেই বাসে হামলা। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাত লাগে সুবীরবাবুর স্ত্রী পূরবীদেবীর মুখে। বৃদ্ধের কথায়, ‘‘আমার হাতে স্প্লিন্টার লেগেছিল। আশিসও যে আহত, প্রথমে বুঝতেই পারিনি। কারণ, সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত লাগিয়ে অন্য আহতদের ও-ই তো হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। পরের দিন আশিস মারা যায়।’’ হাসপাতালে নিজের স্ত্রী-সহ মৃত ছ’জনকে চিহ্নিত করেন সুবীরবাবু।
তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময়ে পাশেই ছিলেন ছেলে শুভ্রজিৎ। মার্চেন্ট নেভির কর্মী শুভ্রজিতের কথায়, ‘‘আমারও সে বার বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষা ছিল বলে শেষ মুহূর্তে বাতিল করি।’’ কলকাতা বিমানবন্দরে কফিনের নম্বর মিলিয়ে মা এবং অন্যদের দেহ বুঝে নিতে হয়েছিল তাঁকে।
স্মৃতির সঙ্গে যুঝতে যুঝতে এখনও বেড়াতে যান সুবীরবাবু। তবে একা।