ভোরে ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল অভ্যাসবশেই। তখন সওয়া ৫টা হবে। ঘুম ভেঙেছিল ঠিকই, তবে ঘুমের ঘোর কাটেনি। সাইড লোয়ার বার্থে উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙার তোড়জোড় করছিলাম। ঘোরটা কাটল প্রথমে একটা বিকট আওয়াজ এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পরপর কয়েকটা প্রবল ঝাঁকুনিতে। বার্থ থেকে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে যেতে কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিলাম। নিছক ঠান্ডায় কাঁপছি কি! প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে মালুম হল, এটা তো শুধু ঠান্ডার কাঁপুনি হতে পারে না। ট্রেনের পুরো কামরাটাই কাঁপছে যে!
ঘুমন্ত কামরাটা তত ক্ষণে জেগে উঠেছে। অনেকেই বার্থ থেকে পড়ে গিয়েছেন। কেউ তখনও পড়েই আছেন। উঠেও বসেছেন কেউ কেউ। কিন্তু কীসের শব্দ, ঝাঁকুনিই বা কেন, পড়ে গেলেন কী ভাবে— কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। এটুকু শুধু বোঝা যাচ্ছে যে, বড় ধরনের একটা কিছু ঘটে গিয়েছে। আচম্বিতে এমন একটা ঘটনা— অনেকেই ভয়ে-আতঙ্কে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। এসি কামরার ভিতর থেকে বাইরেটা কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না। হঠাৎ মনে পড়ল আমার প্রিয়জন আর অন্য সঙ্গীদের কথা। এই কামরাতেই আছেন আমার স্ত্রী আর মেয়ে, আছেন আমাদের গ্রুপের আরও ২৫ জন। এস-৮ কামরায় রয়েছেন আরও ১০ জন। কামরার ভিতরে-বাইরে, চার দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার মধ্যে কুয়াশা আর ধোঁয়া পুরো পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।
মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে কোনও রকমে স্ত্রী-মেয়েকে খুঁজে বার করলাম। কামরা থেকে বেরোনোর জন্য তখন হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। সকলেই সকলকে টপকে আগে বেরোনোর চেষ্টা করছেন। অনেক চেষ্টার পরে কামরা থেকে বেরোলাম বাকিদের খোঁজে। বাইরে তখন কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না। প্যান্ট্রিকারটা পেরিয়েই হতভম্ব হয়ে গেলাম। এত দিন ছবিতে, টেলিভিশনে যা যা দেখেছি— সবই এখন চোখের সামনে! একটার উপরে আর একটা কামরা উঠে গিয়েছে। প্যান্ট্রিকারের পরের সব ক’টা কামরা কয়েকটা বাক্সের মতো লাইনের চার পাশে ছড়িয়ে রয়েছে। কামরার মাথায় চড়ে বসেছে কামরা। একটা কামরা তো উঠে গিয়েছে প্ল্যাটফর্মের উপরে!
ধুলো, ধোঁয়া আর কুয়াশা কাটিয়ে কোনও রকমে এস-৮ কামরার সামনে পৌঁছে দেখি, সেটা উল্টে গিয়েছে। মোবাইলের আবছা আলোয় ‘ইমার্জেন্সি উইন্ডো’ খুঁজে বার করলাম। সেটার কাচ ভেঙে ভিতর থেকে বার করা হল আটকে পড়া যাত্রীদের। আমাদের সঙ্গে আসা সমরেন্দ্রনাথ সেনের নাক আর মাথা ফেটে গিয়ে তখন রক্তারক্তি কাণ্ড। তত ক্ষণে ৬টা বেজে গিয়েছে। একে একে রেলের অফিসার, উদ্ধারকাজের দল এসে ঢুকতে শুরু করেছে। সমরেন্দ্রকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করানো হল।
বলতেই হবে, ভাগ্য আমাদের সহায় ছিল। অল্পস্বল্প আঘাত ছাড়া আমাদের দলের কারও বড়সড় চোট-আঘাত লাগেনি। প্যান্ট্রিকারের সামনের কামরাগুলি নিয়ে এর পরে ট্রেন রওনা হল জয়পুরের দিকে। আমরাও রওনা দিয়েছি। বহু বার বেড়াতে বেরিয়েছি। কখনও এ-রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। বেড়াতে যাওয়ার আনন্দটাই আলাদা। এ বার সেই আনন্দটাই যেন মাটি হয়ে গেল। জয়পুরের দিকে যাচ্ছি বটে, কিন্তু চোখ বুজলেই এলোপাথাড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কামরার দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছে সামনে। আর কানে বাজছে অসহায় যাত্রীদের আর্তনাদ। আমাদের জয়পুর, চিতোর, অজমের শরিফ-সহ কয়েকটা জায়গা ঘুরে দেখার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত কী হবে, জানি না! এখন আর কিছু করার নেই। আগে আমরা গিয়ে জয়পুরে নামি। সেখানে সকলে মিলে বসে ঠিক করব, আদৌ আর যাব, নাকি ফেরার পথ ধরব।