বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আন্তর্জাতিক কার্যকরী সভাপতি অলোক কুমার। — ফাইল চিত্র।
প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্বে। সোমবার সকাল হলেই শুরু হয়ে যাবে বহু প্রতিক্ষিত উদ্বোধন পর্ব। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এসে যাবেন। আসবেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে উদ্বোধন। অভিজিৎ মুহূর্তে ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ হবে রামলালার নতুন মূর্তির। তার ঠিক আগে অযোধ্যায় এসে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আন্তর্জাতিক কার্যকরী সভাপতি অলোক কুমারের দাবি, রাম কারও একার নয়। রামকে নিয়ে ভোটের রাজনীতি করা ঠিক নয়। দাবি করলেন, বিজেপির পাশাপাশি দেশের সব রাজনৈতিক দলের জন্যই রামের আশীর্বাদ থাকবে।
উত্তর ভারতে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, দক্ষিণে বড়ই দুর্বল বিজেপি। মোদী অযোধ্যা আসার আগে দক্ষিণে একের পর এক মন্দিরে ভ্রমণ করেছেন। লোকসভা নির্বাচনের আগে আগে ১১ দিন শুধুই ডাবের জল খেয়ে রাম-রাজনীতির ক্ষেত্রে উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণকে জোড়ার কাজ করছেন। অন্য দিকে পূর্বের পশ্চিমবঙ্গেও হিন্দুত্ব রাজনীতির আবহ তৈরি করতে মরিয়া বিজেপি। প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ১০১ কেজি মধু পাঠানোর খবর প্রকাশ্যে আসতে না-আসতেই নিজের লোকসভা এলাকা বালুরঘাটের কাছে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এক গ্রাম থেকে ‘চিনি আতপ’ চাল পাঠিয়েছেন বর্তমান রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। সোমবার সেই ১১০০ কেজি চাল অযোধ্যায় পৌঁছলে ভোগের পরমান্ন রান্না হবে। এত কিছুর পরেও রাম রাজনীতির নয় বলেই দাবি করলেন অলোক।
আনন্দবাজার অনলাইনকে অলোক বললেন, ‘‘যে যা-ই করুক, যা-ই ভাবুক, রাম কোনও রাজনৈতিক দলের নয়। রাম সবার। রাম কখনও ভোটের ইস্যু হতে পারেন না।’’ এই রামকে কেন্দ্র করেই তো একের পর এক নির্বাচনে এগিয়ে আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে দেশের ক্ষমতায় বিজেপি। আর সেই দলের নেতার হাতেই তো উদ্বোধন। অলোকের দাবি, ‘‘দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই তাঁকে আমরা আমন্ত্রণ করেছি। আমরা তো বিরোধীদেরও ডেকেছি। কিন্তু বিজেপি যদি এই সুবিধা একা নিয়ে নেয় তার দায় তো আমাদের নয়। বাকিরা এলেন না কেন?’’ মোদীর সোমবারের কর্মসূচি নিয়েও অলোকের দাবি, ধর্মীয় কর্মসূচি ছাড়া কোনও জনসভা নয়, আগত অতিথিদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু অলোক যেটা বললেন না সেটা হল, গোটা দেশ শুনতে পাবে মোদীর সেই রাম-বাণী।
এই ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ যে লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে, তারই তো প্রমাণ অসম্পূর্ণ মন্দিরেরই উদ্বোধন... প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই অলোক বলেন, ‘‘এর মধ্যে নতুন কিছু নেই। সোমনাথ মন্দির অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই উদ্বোধন করেছিলেন পণ্ডিত নেহরু। রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগে রামজি যে বালির শিবলিঙ্গ বানিয়েছিলেন তার তো কোনও ছাদও ছিল না।’’ একই সঙ্গে অলোক বলেন, ‘‘কোনও তাড়াহুড়ো করা হয়নি। মাথার উপরে ছাদ তৈরি হয়ে গেলে সকলেই নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। এর পরে বাড়ির দোতলা, তিন তলার কাজ চলতে থাকে। গর্ভগৃহ তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে কেন রামলালাকে অস্থায়ী মন্দিরে রেখে দেওয়া হবে? সেটা কি উচিত কাজ?’’
রাম জন্মভূমি ট্রাস্ট ইতিমধ্যেই দাবি করেছে, মন্দির সম্পূর্ণ হতে হতে ২০২৫ সাল বা ২০২৬ সালের প্রথম দিক হয়ে যাবে। তখন কি আবার এমন করে উদ্বোধনের আয়োজন করা হবে। অলোক বলেন, ‘‘সেটা ট্রাস্ট ঠিক করবে। তবে আমরা মনে করি রাম সবার। রামকে নিয়ে সারা বছরই উৎসব হওয়া দরকার। রামকে যাঁরা ভগবান মানেন তাঁদের কাছে তো বটেই, রামকে যাঁরা ঐতিহাসিক পুরুষ ভাবেন তাঁদের কাছেও রাম যুগপুরুষ। ভগবানে অবিশ্বাসীদের কাছেও রাম মানে ন্যায়ের প্রতীক।’’ এই প্রসঙ্গেই তিনি রাজনীতির কথা নিয়ে আসেন। বলেন, ‘‘মুঘল বা ব্রিটিশ নয়, খারাপ লাগে যখন আমাদের লোকেরাই, আমাদের নির্বাচিত সরকারই রামমন্দিরের বিরোধিতা করে।’’ তিনি এমনটাও দাবি করেন যে, রাম সব ধর্মেরও। অলোক বলেন, ‘‘অযোধ্যার অনুষ্ঠান আসলে অতীতের লড়াই ভুলে সকলকে নিয়ে চলার জন্য সমন্বয়ের অনুষ্ঠান।’’ তিনি জানান, অযোধ্যা-সহ দেশের অনেক গুরুদ্বারে এই সময়ে অনুষ্ঠান চলছে। জৈনরাও রামমন্দির উদ্বোধনের আনন্দ পালন করছেন। কাশ্মীর থেকে মুসলিমরা রামন্দিরের জন্য দু’কেজি কেশর তাঁর হাতেই দিয়েছেন বলেও জানালেন অলোক।
রাম নিয়ে রাজনীতির বিরোধিতা করলেও অলোকের কথায় কথায় রাজনীতি। অন্য রাজনৈতিক দলের থেকে বেশি আক্রমণ কংগ্রেসকে। তিনি বলেন, ‘‘অরবিন্দ কেজরীবাল, অখিলেশ যাদব, শরদ পাওয়ারেরা পরে আসবেন বলেছেন। খালি কংগ্রেস আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে। আসলে কংগ্রেস নেতারা দলের কর্মীদের সঙ্গেই সংযুক্ত নন। কর্মীরা সরযূতে ডুব দিচ্ছেন আর নেতারা দূরে বসে রয়েছেন। সকলে এলে আর বিজেপির একার হয়ে যেত না এই আয়োজন। সবাই রাজনীতির ঊর্ধে উঠলে রামের উৎসব মিলনের হতে পারত।’’ এই প্রসঙ্গেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাও তুললেন অলোক। বললেন, ‘‘মমতা দিদি রাজনৈতিক মঞ্চে চণ্ডীপাঠ করেন। কিন্তু রামের বিরোধিতা করেন। আমি তো বলব দিদি একজন হিন্দু হিসাবে যদি অযোধ্যায় আসেন তবে তাঁর মঙ্গল হবে। রামজির কৃপা পাবেন।’’ একই সঙ্গে তাঁর দাবি, যেমনটা প্রচার হচ্ছে তেমন ভাবে মুসলিমরাও এই মন্দিরের বিরুদ্ধে নন। দেশের কোথাও কেউ ভাবে না ‘মুসলিম খতরে মে’।
অযোধ্যার কর্মসূচি নিয়ে প্রথম থেকেই শঙ্করাচার্যদের বিরোধিতা বিতর্ক তৈরি করেছে। তা নিয়েও অলোকের দাবি, ‘‘এটা যতটা প্রচার হয়েছে ততটা নয়। দু’জন শঙ্করাচার্য তো লিখিত ভাবে জানিয়েছেন তাঁরা বিরোধ করছেন না।’’ কিন্তু জ্যোতিষপীঠের শঙ্করাচার্য অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী তো এখনও অসম্পূর্ণ মন্দির উদ্বোধন ঠিক হচ্ছে না বলে সিদ্ধান্ত বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন। এর উত্তরে কিছু বলবেন না জানিয়ে অলোকের দাবি, ‘‘ওই শঙ্করাচার্যের নিয়োগ নিয়েই তো প্রশ্ন রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টা বিচারাধীন।’’
তবে এখন আর এ সব বিতর্কে নজর নেই অযোধ্যার। সাজগোজ সম্পূর্ণ করে আপাতত ‘অভিজিৎ’ মুহূর্তের অপেক্ষায় ভক্ত থেকে পর্যটক সকলেই। অবশ্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রধান অলোকের দাবি অনুযায়ী, অযোধ্যায় আসা কেউই ‘পর্যটক’ নন, সকলেই ‘পুণ্যার্থী’।