কলকাতার কথা উঠলেই একটা গল্প তাঁর মুখে ফিরে ফিরে আসত। ‘সিটি অব জয়’-এ অভিনয়ের জন্য রিকশা টানা অভ্যাস করছিলেন কিছু দিন। এক দিন রিকশা নিয়েই চলে গিয়েছেন সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। দারোয়ান ঢুকতে দিতে রাজি নন! ওম পুরীকে দেখে তখন তো রিকশাচালক ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না!
৬৬ বছর বয়সে সেই রকমই পুরোদমে কাজ করতে করতে আচমকা চলে গেলেন ওম।
সকাল এগারোটায় সংবাদসংস্থা পিটিআইকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা ছিল। ভোরে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক। আন্ধেরির বাড়িতে রান্নাঘরেই লুটিয়ে পড়েছিলেন। এই অকস্মাৎ প্রয়াণে মুহ্যমান হয়ে থাকল পর্দা আর মঞ্চ, জনপ্রিয় আর সমান্তরাল ছবির জগত। এক দিকে অমিতাভ-শাহরুখ-সলমনদের শ্রদ্ধার্ঘ, অন্য দিকে নাসিরুদ্দিন-শাবানা-অনুপম খেরের মতো বন্ধুদের শোক। নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি বা ইরফান খান বিহ্বল, অশক্ত শরীরে হুইলচেয়ারে বসে ঘুরে গেলেন শশী কপূর।
ওম পুরী যে এঁদের সকলের সঙ্গে ইতিহাসের সুতোয় বাঁধা। সত্তরের দশক থেকে শুরু করে ভারতীয় ছবির তথাকথিত নবতরঙ্গ চারটি মুখকে সবচেয়ে বেশি আঁকড়ে ধরেছিল— নাসির, ওম, স্মিতা পাটিল আর শাবানা আজমি। শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালনি, কেতন মেটা, কুন্দন শাহ, সৈয়দ মির্জাদের ছবি মানেই যেন এই চার জনের অনিবার্য উপস্থিতি। জনপ্রিয় মেলোড্রামার তারকাখচিত অভিনয়ের পাশাপাশি গ্ল্যামারবিহীন চরিত্রাভিনয়ের যে ধারা, এই চার জন সেখানে নেতৃস্থানীয়। আজকের নওয়াজ-ইরফানরা সেই ধারাতেই পুষ্ট। নওয়াজ লিখেছেন টুইটে— ‘‘আমার, আমার মতো আরও অনেকের অনুপ্রেরণা উনি।’’
অনুপ্রেরণা তো বটেই। লিকপিকে চেহারা আর মুখভর্তি বসন্তের দাগ নিয়ে যে ছেলেটি এককালে ভাল করে ইংরেজি বলতে পারতেন না— সেই তিনিই একদিন ভারতের
অন্যতম সেরা অভিনেতা হবেন এবং একই সঙ্গে আম্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের নিয়মিত মুখ হয়ে উঠবেন, সেটা গোড়ায় অনেকেই ভাবেননি। ওম পুরী শুধুমাত্র অভিনয়ের জোরে এই প্রায়-অলৌকিক ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন। ছবি-টিভি সিরিজ মিলিয়ে অন্তত ১৭টি ইংরেজি ছবি তাঁর ঝুলিতে। রিচার্ড অ্যাটেনবরো (গাঁধী) থেকে স্টিফেন স্পিলবার্গ (দ্য হান্ড্রেড ফুট জার্নি) তাঁর পরিচালক। টম হ্যাঙ্কস-জুলিয়া রবার্টস (চার্লিজ উইলসন্স ওয়র) থেকে জ্যাক নিকলসন (উল্ফ), হেলেন মিরেন (দ্য হান্ড্রেড ফুট জার্নি) তাঁর সহ-অভিনেতা।
কলকাতা আর বাঙালি পরিচালকদের কাছেও ওম পুরী বরাবরই প্রিয় শিল্পী, কাছের মানুষ। প্রেমচন্দের গল্প অবলম্বনে টিভির জন্য প্রথম ছবি করলেন সত্যজিৎ রায়। ‘সদগতি’। মৃত ওমের পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন মোহন আগাসে, এই আইকনিক দৃশ্য সেখানেই। শুধু সত্যজিৎ-মৃণাল সেনই নয়, গৌতম ঘোষ-উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর একাধিক ছবিতেও কাজ করেছেন ওম। বাম আমলে ভূমিসংস্কারের কাহিনিকে সামনে রেখে রাজ্য সরকারের প্রযোজনায় তৈরি শ্যাম বেনেগালের ‘আরোহণ’ ছবিতে তিনিই মুখ্য ভূমিকায়। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের চরিত্র যেন ওমের সঙ্গে মিলেমিশে যেত। এ দিন যখন ফোনে খবরটা পেলেন, প্রথম কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারেননি শ্যাম।
ওমের কেরিয়ারে অন্যতম সেরা তিনটে চরিত্র এসেছিল শ্যামেরই শিষ্য গোবিন্দ নিহালনির ছবিতে। আক্রোশ, অর্ধসত্য আর তমস। পীড়িত এবং পীড়ক— ওম পুরীর ব্যাপ্তি চমকে দিয়েছিল দর্শককে। পাশাপাশি ওম যে কত ধরনের কমেডি করতেন, মান্ডি থেকে চাচি ৪২০, জানে ভি দো ইয়ারোঁ থেকে হেরাফেরি-র মতো ছবি তার সাক্ষী।
ছোটবেলাটা খুব কষ্টে কেটেছিল। জন্ম পঞ্জাবের অম্বালায়। বাবা রেলে সামান্য চাকরি করতেন। ওম কখনও ধাবায় কাজ করেছেন, কখনও রেললাইন থেকে কয়লা কুড়িয়েছেন। চেহারা ভাল নয় বলে পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে অনেক কটাক্ষ শুনেছিলেন। ওম তার পরে গেলেন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায়। সেখানে নাসিরুদ্দিনকে পেলেন সহপাঠী হিসেবে। বন্ধুত্বের সেই শুরু। ১৯৭৬ সালে মরাঠি ছবি ‘ঘাসিরাম কোতওয়াল’ দিয়ে রুপোলি পর্দায় হাতেখড়ি। এর পর সত্তর-আশির দশক জুড়ে সমান্তরাল ছবিতে পরপর অভিনয়। নব্বইয়ের শুরু থেকে বলিউডের মূল ধারার ছবিতেও জোরকদমে কাজ শুরু। হালে সলমন খানের সঙ্গে ‘বজরঙ্গী ভাইজান’-এ অভিনয় করলেন। সলমনেরই পরের ছবি ‘টিউবলাইটে’ও কাজ করছিলেন। আরও তিন-চারটে ছবি হাতে ছিল। সব ফেলে চলে গেলেন।
এর মধ্যে দ্বিতীয় স্ত্রী নন্দিতা পুরীর সঙ্গে বিচ্ছেদ পর্বটা সুখের ছিল না একেবারেই। স্বামীর জীবনী লিখতে গিয়ে আগের জীবন নিয়ে বড্ড বেশি লিখে ফেলেছেন বলে অভিযোগ ছিল ওমের। স্ত্রীকে বিচ্ছেদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটা তখনই নেন। ২০১৩ সালে ওমের বিরুদ্ধে পারিবারিক হিংসার অভিযোগও আনেন নন্দিতা। তার পর থেকে দু’জন আলাদাই থাকতেন। সম্প্রতি উরি হামলার পরে যখন পাকিস্তানের শিল্পীদের বয়কট করার দাবি উঠল, নিন্দা করেছিলেন ওম। নিহত জওয়ানদের সম্পর্কে বলে ফেলেছিলেন, ওঁরা তো চাকরি হিসেবেই বেছে নিয়েছেন সেনার জীবন! তাই নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হয়। ওম পরে ক্ষমাও চান। যদিও এ দিন তাঁর মৃত্যুর পরেও ‘ভক্ত’দের দল তাঁর পাক-প্রীতি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় হইচই বাধিয়েছে।
বন্ধু গুলজার শুধু লিখেছেন দু’টো লাইন— ‘‘ইস ওয়ক্ত কা জ্বলতে চুলহে মে/ইক দোস্ত কা উপলা অউর গয়া!’’ সময়ের এই জ্বলন্ত চুল্লিতে আরও এক বন্ধু ঘুঁটে হয়ে গেল!
সন্দীপ রায়ের সংযোজন: ‘অর্ধসত্য’ ছবিতে প্রথম ওঁকে পর্দায় দেখেছিলাম। দেখেছিলাম বললে ভুল বলা হবে। বলতে হয় মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। যখন মুখোমুখি হলাম, ওঁর প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। কখন যে আমার জীবনের সঙ্গে উনি জড়িয়ে গেলেন, সেই সময়ের হিসেব আমার কাছে নেই।
বাবার (সত্যজিৎ রায়) ‘সদগতি’-তে কাজ করতে এলেন। তখন সামনে থেকে বুঝলাম, কী ভাবে ওই অভিনয়ের দক্ষতা উনি অর্জন করেছেন। কাজের প্রতি কী আনুগত্য! অভিনয়ের জন্য নিজেকে উনি যেন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। ওম পুরী শুধু বিরাট অভিনেতা ছিলেন না, থিয়েটার এবং সিনেমা সম্পর্কে ওঁর জ্ঞান ছিল ঈর্ষা করার মতো। পাশাপাশি উনি ছিলেন অত্যন্ত ভাল মনের মানুষ। থিয়েটারের জগত থেকে এসেছিলেন। সেই জন্যই হয়তো সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ওঁর। আমার সঙ্গে ‘শোধ’ নামে একটি টেলিভিশন সিরিজে কাজ করেছিলেন। ‘টার্গেট’ বলে একটা ছবিতেও করেছিলেন। দেখতাম, কাজের ফাঁকে উনি টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে যেমন আড্ডা দিতেন, তেমনই কলাকুশলীদের সঙ্গেও মন খুলে গল্প করতেন। সব সময় বলতেন, এক জন শিল্পী সকলের থেকে কিছু না কিছু শেখে। শেখার আগ্রহই ওঁকে আরও বড় মাপের মানুষ করে তুলেছিল।
ভাবতেই পারছি না ওম নেই।