রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাই কমিশনার বেরোনিকা মিচেল বাচেলে খেরিয়া। ছবি: রয়টার্স।
গত দু’মাস ধরে আন্তর্জাতিক মহলে সিএএ-এনআরসি নিয়ে ক্রমশ চাপ বাড়ছে মোদী সরকারের উপরে। আজ সেই চাপ বাড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টে সিএএ-মামলায় আদালত-বান্ধব হিসাবে শামিল হতে চাইলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাই কমিশনার বেরোনিকা মিচেল বাচেলে খেরিয়া। ভারত এর প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, এটি একান্ত ভাবেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কোনও বিদেশি পক্ষের এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।
রাষ্ট্রপুঞ্জের আবেদন সুপ্রিম কোর্ট গ্রহণ করবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে একাধিক মতামত রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। তবে আইনি প্রক্রিয়া যে পথেই এগোক না কেন, রাষ্ট্রপুঞ্জ সরাসরি এই মামলায় শামিল (ইন্টারভেনশন অ্যাপ্লিকেশন) হতে চাওয়ায় এক ধাক্কায় বিশ্বের আতসকাচের তলায় চলে এল মোদী সরকারের নয়া নাগরিকত্ব আইন।
হাই কমিশনার আজ যে আবেদন সুপ্রিম কোর্টে করেছেন, সেখানে গোড়াতেই বলা হয়েছে, সিএএ-তে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান—এই প্রতিবেশী দেশগুলিতে নিপীড়নের শিকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্য অবশ্যই প্রশংসনীয়। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, ধর্মের ভিত্তিতে যে ভেদাভেদ করা হচ্ছে তা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কি না, তা দেখার বিষয়। মুসলিমেরা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে এলেও ভারতে কোনও সুবিধা পাচ্ছেন না। অথচ আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে শিয়া, আহমদি ও হাজারা সম্প্রদায় মুসলমান হলেও সংখ্যালঘু। তাঁরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন বলে মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে। খেরিয়ার বক্তব্য, ভারতে আশ্রয় নেওয়া ওই সম্প্রদায়ভুক্তদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হলে আবার নিপীড়নের মুখে পড়তে পারেন। এখানেই সব থেকে বড় আপত্তি রাষ্ট্রপুঞ্জের। কমিশনারের বক্তব্য, নিপীড়নের শিকার হবে জেনেও কাউকে তার দেশে ফেরত পাঠানোর উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের। ভারত এই সনদ মানতে দায়বদ্ধ।
বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রভীশ কুমার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘সিএএ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারতের সংসদে পাশ হয়েছে এই আইন। আমরা দৃঢ় ভাবে মনে করি, কোনও বিদেশি পক্ষের ভারতের সার্বভৌমত্ব নিয়ে নাক গলানোর অধিকার নেই।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমরা নিশ্চিত যে সিএএ-র সাংবিধানিক বৈধতা রয়েছে। আমাদের সংবিধানের মূল্যবোধের সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ। দেশভাগের বেদনার পর মানবাধিকার সংক্রান্ত যে সব সমস্যা তৈরি হয়েছে বা প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সেগুলিকে আমরা যথাযোগ্য মর্যাদা দিই। দেশের স্বাধীন বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থায় আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এই আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে আমাদের শক্তিশালী এবং আইনানুগ অবস্থানে সুপ্রিম কোর্ট সিলমোহর দেবে।’’
প্রশ্ন উঠছে, হাই কমিশনারের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট এগোবে কি না। এই নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতভেদ রয়েছে। প্রথম বক্তব্য, এটি পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ বিষয়। সুতরাং গোড়াতেই আদালত তা খারিজ করতে পারে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ পি ডি টি আচারিয়ার বক্তব্য, ‘‘রাষ্ট্রপুঞ্জকে বিদেশি রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা যাবে না। সেখানে সকলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।’’ পাল্টা যুক্তি হল, মানবাধিকার সংক্রান্ত হাই কমিশনার ‘আদালতের বন্ধু’ হিসাবে কাজ করতে চেয়ে আর্জি জানিয়েছেন। ভারত থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর মামলায় রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষ প্রতিনিধি একই ভাবে আর্জি জানিয়েছিলেন সর্বোচ্চ আদালতে। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ তা খারিজ করে দেয়নি। বরং এই বিষয়ে কেন্দ্রের বক্তব্য জানতে চেয়েছে।