খাস জমিতেই গোলাপ বাগান, মানল ত্রিপুরা

খাস জমি দখল করে ও প্রয়োজনীয় অনুমতি ছাড়াই উপজাতিদের জমি কিনে নিয়ে রোজ ভ্যালি পার্ক তৈরির যে অভিযোগ কংগ্রেস করেছে, তার সত্যতা স্বীকার করে নিল ত্রিপুরার বামফ্রন্ট সরকার। তবে সরকারের বক্তব্য, এই ঘটনা জানার পরে সরকারই রোজ ভ্যালির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকারের পক্ষে আজ বক্তব্য রাখতে গিয়ে ত্রিপুরার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তথা বর্তমান রাজস্বমন্ত্রী বাদল চৌধুরী স্বীকার করেন, ব্যবস্থা নিতে তাঁদের তিন বছর সময় লেগেছিল।

Advertisement

আশিস বসু

আগরতলা শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৮
Share:

খাস জমি দখল করে ও প্রয়োজনীয় অনুমতি ছাড়াই উপজাতিদের জমি কিনে নিয়ে রোজ ভ্যালি পার্ক তৈরির যে অভিযোগ কংগ্রেস করেছে, তার সত্যতা স্বীকার করে নিল ত্রিপুরার বামফ্রন্ট সরকার। তবে সরকারের বক্তব্য, এই ঘটনা জানার পরে সরকারই রোজ ভ্যালির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকারের পক্ষে আজ বক্তব্য রাখতে গিয়ে ত্রিপুরার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তথা বর্তমান রাজস্বমন্ত্রী বাদল চৌধুরী স্বীকার করেন, ব্যবস্থা নিতে তাঁদের তিন বছর সময় লেগেছিল।

Advertisement

এতটা সময় লাগার কারণ কী?

বাদলবাবু এর জন্য দায়ী করেছেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে।

Advertisement

মুখমন্ত্রী মানিক সরকার ২০০৮ সালের আগে রোজ ভ্যালি সংস্থার সম্পর্কে কিছু জানতেন না বলে দাবি করলেও, তাঁর সরকারেরই প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী বাদলবাবু এ দিন উল্টো কথাই বলেছেন। তাঁর দাবি, সেবি ১৯৯৯ সালেই রোজ ভ্যালির কথা রাজ্য সরকারকে জানিয়েছিল।

গত কালই সমস্ত নথি হাতে নিয়ে বিরোধী দলনেতা, কংগ্রেসের সুদীপ রায়বর্মন অভিযোগ করেন, ত্রিপুরা সরকারের সক্রিয় মদতেই রোজ ভ্যালি কর্তৃপক্ষ খাস জমি দখল করে পার্কটি তৈরি করেছেন। এবং সেই পার্কের উদ্বোধন করেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। তাঁর অভিযোগ এই দু’টি ঘটনা থেকেই প্রমাণ হয় রোজ ভ্যালি কর্তার মাথায় মানিক সরকারের হাত না থাকলে এ ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। সেই অভিযোগের জবাব দিতেই আজ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বাদলবাবু। ওই খাস জমি রোজ ভ্যালিকে রাজ্য সরকার দেয়নি বলেও তিনি দাবি করেন।

খাস জমি দখল করে রোজ ভ্যালির পার্ক তৈরির বিষয়ে বাদলবাবুর আজকের স্বীকারোক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন সুদীপ রায়বর্মন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘তা হলে রোজ ভ্যালির বিষয়ে কংগ্রেসের অভিযোগ সত্য হল? দেখা যাক এ বার সিবিআই
কী করে!’’

এ দিন ঠিক কী বলেছেন রাজস্বমন্ত্রী? তাঁর কথায়, ‘‘রোজ ভ্যালি যে কিছুটা খাস জমি দখল করে বিনোদন পার্কটি তৈরি করেছে, ২০০৮ সালেই তা রাজ্য সরকারের নজরে আসে। এটা জানার পরে অবশ্য রাজ্য সরকার বসে ছিল না। খাস জমিটি রোজ ভ্যালির হাত থেকে উদ্ধার করতে আইনি নোটিস পাঠানো হয় ২০১১ সালে।’’ শুধু একটা নোটিস পাঠাতেই কেন পাক্কা তিন বছর লেগে গেল? এই প্রশ্নের উত্তরে রাজস্বমন্ত্রী জানান, ‘‘ভূমি ও রাজস্ব দফতরের কাছ থেকে এ বিষয়ের কাগজপত্র উদ্ধার করতে সময় লেগেছিল।’’ একে অবশ্য রাজ্য সরকারের গাফিলতি বলে মনে করছেন না বাদলবাবু। তাঁর মতে, এটা নেহাৎই লাল ফিতের বাঁধন, তথা আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা।

খাস জমি পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে বামফ্রন্ট সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবে উদাসীন থেকেছে, এমন অভিযোগ উড়িয়ে বাদলবাবু বলেন, ‘‘জমি উদ্ধারের ক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে তো বলপ্রয়োগ করা যায় না। তাই আইনের আশ্রয় নিয়েছে রাজ্য সরকার। মামলা এখন আদালতে, মীমাংসা হয়নি।’’

খাস জমি দখল করার কথা জেনেও রোজ ভ্যালির পার্কটি কেন বন্ধ করেনি রাজ্য সরকার? এ ব্যাপারে মন্ত্রীর প্রথম যুক্তি হল, বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। এবং বিচারাধীন বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ করতে পারে না। মন্ত্রীর দ্বিতীয় যুক্তি, ‘‘পার্কের সমস্ত জমি তো খাস নয়।’’

এটা ঘটনা, ওই পার্কের মোট ৩৯ একর জমির মধ্যে প্রায় ২০ একর রোজ ভ্যালি ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে আইনি পদ্ধতি মেনেই কিনেছে। কিন্তু ১৩ একরের মতো খাস জমি তারা সরাসরি দখল করেছে বলে অভিযোগ। এ ছাড়াও ৫ একরের কিছু বেশি জমি তারা উপজাতি পরিবারগুলির কাছ থেকে দখল করেছে বলে অভিযোগ। ত্রিপুরার আইন অনুযায়ী উপজাতিদের জমি কেউই সরকারের ‘বিশেষ অনুমতি’ ছাড়া কিনতে পারে না। রোজ ভ্যালি সরকারের কাছ থেকে সেই অনুমতি নেয়নি। এই প্রসঙ্গে বাদলবাবু বলেন, ‘‘সংস্থাটি যে বেআইনি কাজ করেছে, এটা ঠিক। কিন্তু রাজ্য সরকারও আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে।’’

সরকারই এখন মানছে ‘বেআইনি’ কাজকর্ম করে জমি জোগাড় করে বিনোদন পার্ক গড়েছে রোজ ভ্যালি। অথচ মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার নিজে গিয়ে তার উদ্বোধন করেছিলেন! এটা কেন হল? এই প্রসঙ্গে বলত গিয়ে রাজ্যের রাজস্বমন্ত্রী কিন্তু বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেই। রোজ ভ্যালির পার্ক নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে দেখে মনিকবাবু সম্প্রতি দাবি করেছেন, ‘‘২০০৮ সালের আগে রোজ ভ্যালির সম্পর্কে তিনি কিছু জানতেন না।’’ মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানের কার্যত বিরোধিতা করেই প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী বাদল চৌধুরী আজ বলেন, ‘‘সেবি ১৯৯৯ সালেই রাজ্য সরকারকে রোজ ভ্যালির মতো সংস্থার বিষয়ে জানিয়েছিল।’’ তার আগেই কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের তত্‌কালীন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হাকে এবং পরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে রোজ ভ্যালির মতো বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়নের জন্য অনুরোধ করেন ত্রিপুরার তত্‌কালীন অর্থমন্ত্রী। বাদলবাবু আজ সে কথাও উল্লেখ করেন।

কিন্তু এর পরেও ত্রিপুরায় বিভিন্ন বেসরকারি অর্থ লগ্নি সংস্থার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, বিভিন্ন মন্ত্রী, বিধায়করা কী করে হাজির হন? অস্বস্তি নিয়েই এ প্রসঙ্গে বাদলবাবুর সাফ উত্তর, ‘‘কোন মন্ত্রী কোথায় গিয়েছেন, কেন গিয়েছেন, তার উত্তর আমার জানা নেই। অর্থ দফতরের অনুমতি নিয়ে ওঁরা তো যাননি।’’ এর পরে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘ওঁরা হয়তো এ বিষয়ে ‘ইনোসেন্ট’ ছিলেন।’’ উপজাতি পরিবারের জমি, সরকারি খাস জমি দখল করে বিনোদন পার্ক তৈরি করেও রাজ্য সরকারকে ২০১৩ সালে রোজ ভ্যালি প্রায় ৩২ লক্ষ টাকা, ২০১২ সালে ২৮ লক্ষ টাকা রাজস্ব দিয়েছে। জমি দখলদার কোনও সংস্থার কাছ থেকে রাজ্য সরকার রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারে? রাজস্বমন্ত্রী এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে বলেন, ‘‘বিনোদনের জন্য রাজ্য সরকার কর সংগ্রহ করে। কোনও সংস্থা যদি সেই ‘বিনোদন কর’ দিতে চায়, রাজস্ব দফতর তা নিতে পারে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement