প্রতীকী ছবি।
ভোটের প্রচারে দেদার প্রতিশ্রুতি ও সরকারি প্রকল্পের ছড়াছড়ি। সকলের কথায় ভরসা রাখলে ব্যাঙ্কে টাকা, পকেটে চাকরি, রান্নাঘরে অফুরান গ্যাস আটকায় কে! কিন্তু আটকাচ্ছে তো বটেই। নরেন্দ্র মোদী বা রাহুল গাঁধীরা খবরই রাখেন না, এনআরসি-র গিনিপিগ থেকে অসমে কী অভিনব সমস্যা দেখা দিয়েছে, যার নাম ‘বায়োমেট্রিক লক’!
অসমে এত দিন পরে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প বা ব্যাঙ্কে আধার কার্ড বাধ্যতামূলক হওয়ায়, তা তৈরি করাতে গিয়ে রাজ্যের প্রায় ৩৮ লক্ষ মানুষ দেখেন, তাঁদের বায়োমেট্রিক লিঙ্ক ইতিমধ্যেই তালাবন্ধ! কারণ, জানতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোয়। খসড়াছুট থাকার সময় তাঁদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেই তথ্যই এখন তালাবন্দি। ফলে নতুন করে আধারে বায়োমেট্রিক লিঙ্ক করা যাচ্ছে না।
ইউআইডিএআই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, চূড়ান্ত এনআরসি তালিকায় কাদের নাম শেষ পর্যন্ত উঠেছে— সেই এআরএন পেলে লক খুলবে। এনআরসি কো-অর্ডিনেটর কেন্দ্রের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বলেছেন, লক খুলে দেওয়া হোক। কারণ এনআরসি এখনও নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত নয়। কবে কাজ শেষ হবে তারও ঠিক নেই। রাজ্য সরকার বলছে, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বায়োমেট্রিক তালা খোলানোর চেষ্টা হচ্ছে। আরজিআই সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানালে তবেই কাজ হবে।
অসম সংখ্যালঘু সংগ্রাম পরিষদের প্রশ্ন, জনসভায় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কথা বলা নেতারা কি এই সমস্যার খবর রাখেন? সরকারি চক্রান্তে সংখ্যালঘু, বাঙালি, রাজবংশী, হাজোংদের অনেকে আধার কার্ড পাচ্ছেন না। ফলে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলা বা অন্য লেনদেন বন্ধ। পড়ুয়ারা পাচ্ছে না বৃত্তি, গরিবরা পাচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা।
মহিলাদের সম্মান জানাতে কংগ্রেস মাসে ২ হাজার টাকা ও বিজেপি ৩০ লক্ষ পরিবারের মহিলাদের মাসে ৩ হাজার টাকা করে দেবে কথা দিয়েছে। কিন্তু হাজার হাজার পরিবারে মহিলাদের নাম এনআরসি-তে নেই। এনআরসি চূড়ান্ত হলে কালক্রমে তাঁদের হয়ত ঠাঁই হবে ডিটেনশন শিবিরে, ভেঙে যাবে পরিবার। এঁদের কথা কিন্তু কোনও দলের ইস্তাহারে নেই।
জলপাইগুড়ি থেকে গুয়াহাটির বাঙালি পরিবারে বিয়ে হয়ে আসা রুনা সরস্বতী, পানবাজারে শুভ্রজ্যোতি সেনগুপ্তের স্ত্রী দোলন সেনগুপ্ত, জলপাইগুড়ি থেকে বিয়ে হয়ে গুয়াহাটিতে থিতু হওয়া মুকুল বসু, গোয়ালপাড়ার সাবিনা বেগম, ধুবুড়ির মতিয়ারি বিবি, ছয়গাঁওয়ের মেহেরুন্নেসা বিবি— সবারই কাহিনি এক। দোলনদেবী, রুনাদেবীদের সব নথি থাকতেও নাম বাদ। মেহরুন্নিসা, সাবিনাদের পঞ্চায়েতের নথি কাজে দেয়নি। বিয়ের সার্টিফিকেট ছিল না। কেউ আবার বাবার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক প্রমাণ করতে পারেননি। ‘বিদেশি’ স্ত্রীদের ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা নিয়ে ভাঙনের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে পরিবারগুলি।
গত পাঁচ বছরে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে বিজেপিকে আঁকড়ে থাকা বাঙালি সংগঠনের নেতারাও ভোটের মুখে দিশাহারা। সারা অসম বাঙালি যুব-ছাত্র ফেডারেশনের নেতা সম্রাট ভাওয়ালের দাবি, ভোটের স্বার্থে বাঙালিদের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আরও বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি। বাঙালিদের ফের ভয় দেখাতে এখন অসম চুক্তির ষষ্ঠ দফা রূপায়ণ বা ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ করার কথা বলা হচ্ছে। পুরনো ভোটার তালিকা সংরক্ষণ ও ডিজিটাইজ় করার সময় অনেক পাতা হারিয়েছে। ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকার একটা পাতায় গড়ে ২৫টি নাম থাকলে আজ সেই বংশবৃক্ষে সদস্য শতাধিক। কোথায় মিলবে ১৯৫১ সালের ভারতীয়ত্বের প্রমাণ!
সম্রাট বলেন, “যারাই ক্ষমতায় আসুক, আর এক বছর দেখব। বাঙালিদের প্রতি অবিচার বন্ধ না-হলে, জনপ্রতিনিধিদের প্রকাশ্যে অপদস্থ করা হবে। তাতে জেল হলে হবে।”