নবকলেবরে জগন্নাথের ‘প্রাণ’ প্রতিষ্ঠা করেন দৈতাপতিরাই

এক জন্মেই বারবার জন্মান্তর হয় জগন্নাথের। পুরুষোত্তম ক্ষেত্র পুরীতে জগন্নাথকে বলা হয় দারুব্রহ্ম। নিম কাঠের তৈরি বিখ্যাত এই বিগ্রহ কিছু বছর পরপর বদলে ফেলা হয়। নতুন নিম কাঠ দিয়ে তৈরি হয় নতুন কলেবর।

Advertisement

অলখ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৫ ০৩:৪৮
Share:

এই নিম গাছের কাঠ থেকেই তৈরি হচ্ছে নতুন বিগ্রহ। — নিজস্ব চিত্র।

এক জন্মেই বারবার জন্মান্তর হয় জগন্নাথের।

Advertisement

পুরুষোত্তম ক্ষেত্র পুরীতে জগন্নাথকে বলা হয় দারুব্রহ্ম। নিম কাঠের তৈরি বিখ্যাত এই বিগ্রহ কিছু বছর পরপর বদলে ফেলা হয়। নতুন নিম কাঠ দিয়ে তৈরি হয় নতুন কলেবর। ভারতে আর কোনও বিগ্রহের ক্ষেত্রে এমন রীতির কথা শোনা যায় না। কিন্তু পুরনো অবয়বটি থেকে ‘ব্রহ্মবস্তু’ নামে কোনও একটি পদার্থ নতুন কলেবরে প্রতিষ্ঠাও করতে হয়। মনে করা হয়, ওই বস্তুটিই নিম কাঠের তৈরি বিগ্রহের ‘প্রাণ’ বা ‘আত্মা’। পুরীর মন্দিরের প্রাচীন রীতি মতো তা করা উচিত কৃষ্ণা চতুর্দশীর মধ্য রাতে। সারা পুরীর সব আলো নিভিয়ে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে চার প্রবীণ দৈতাপতি পাণ্ডা চোখ বেঁধে পুরনো অবয়বটি থেকে নতুন কলেবরের মধ্যে ‘ব্রহ্মবস্তু’ রেখে দেন পরম ভক্তি ভরে। তাঁদের হাতে থাকে আবরণ। যাতে ত্বকের স্পর্শ এড়ানো যায়।

স্নানযাত্রার সময়ই বিগ্রহগুলিকে রত্নবেদি থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় স্নানবেদিতে। তা রপর নিয়ে আসা হয় মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে অনসর পিণ্ডিতে। ওখানেই সেবা-পুজো করা হয় জগন্নাথ, বলরাম, সু‌ভদ্রার। তার দায়িত্বে থাকেন দৈতাপতিরাই। মন্দিরের উত্তর দ্বার বা হস্তি দ্বারের কাছের ‘কৈলী বৈকুণ্ঠ’ চত্বর থেকে সেখানেই নিয়ে আসা হয় নতুন বিগ্রহগুলি। তারপরেই অনসর পিণ্ডিতেই নিকষ অন্ধকারের মধ্যে পুরনো বিগ্রহটি থেকে ‘ব্রহ্মবস্তু’ স্থানান্তরিত করা হয় নতুন বিগ্রহে।

Advertisement

জগন্নাথ বিগ্রহের এই নতুন রূপ পাওয়ার বিশেষ উৎসবটির নাম নবকলেবর। চান্দ্র ও সৌর বর্ষের মধ্যে সমতা আনতে প্রতি তিন বছরে একটি করে চান্দ্রমাস বাদ দেওয়া হয়। এই মাসটিকে বলা হয় অধিমাস। অধিমাস এমনিতে মল মাস অর্থাৎ এই মাসে বিয়ে, অন্নপ্রাশনের মতো শুভ কাজ হয় না। কিন্তু শাস্ত্রীয় আচারের ক্ষেত্রে এই মাসটি প্রকৃষ্ট বলে মনে করেন স্মার্ত পণ্ডিতেরা। যে বছর আষাঢ়ে অধিমাস পড়ে, সে বছর পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে বিগ্রহের নবকলেবর হয়। এ বার সেই আষাঢ়।

শেষ বার পুরীর জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ও সুদর্শনের নবকলেবর হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। সুদর্শন হল একটি কাঠের দণ্ড। যা বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রের প্রতীক। ১৯ বছর পর এ বছর নবকলেবর নিয়ে প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল অনেক দিন থেকেই। আগ্রহ ছিল তুঙ্গে।

কিন্তু মধ্য রাতে ব্রহ্মবস্তু স্থাপনের নিয়মটি মানা হয়নি বলে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। চতুর্দশী ছিল ১৫ জুন। দৈতাপতিরা সে রাতে পুরনো বিগ্রহটি থেকে নতুন বিগ্রহে ‘ব্রহ্মবস্তু’ স্থাপন করতে পারেননি। ১৬ জুন বিকেল পর্যন্ত গড়িয়েছে সেই প্রক্রিয়া। তা নিয়ে উত্তাল ভক্তেরা। সুপ্রাচীন এই রীতি লঙ্ঘন হওয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে ওড়িশার বাইরেও।

তবে মন্দির সূত্রে জানা গিয়েছে, তিথিগত ভাবে কোনও ভুল হয়নি। ব্রহ্মবস্তু স্থাপনের এই প্রক্রিয়া পূর্ণ করতে ১২ ঘণ্টা মতো লাগে। ১৯৭৭ সালে রাত ১২টা থেকে পরের দিন বেলা ১১টা পর্যন্ত সময় লেগেছিল। ১৯৯৬ সালে এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ভোর ৩টের সময়, শেষ হয় বিকেল ৩টেয়। এ বার ভোর ৪টেয় শুরু হয়ে শেষ হয় বিকেল ৫টায়। কিন্তু পুরোটাই হয়েছে অমাবস্যা তিথির মধ্যেই।

জগন্নাথ বিগ্রহের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একাধিক পৌরাণিক কাহিনি। কাহ্নুচরণ মিশ্রের ‘দ্য কাল্ট অফ শ্রীজগন্নাথ’ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। সেই বই থেকে জানা যাচ্ছে, ‌শবরেরাই নবকলেবরের সময় প্রধান ভূমিকা নেন। পুরাণ মতে, সূর্য বংশের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুর দর্শন পেতে উদগ্রীব হলে এক সন্ন্যাসী তাঁকে নীলমাধব নামে এক দেবতার কথা বলেছিলেন। রাজার পুরোহিত বিদ্যাপতি শেষ পর্যন্ত বি‌শ্বাবসু নামে এক শবরের কাছে এসে সেই বিগ্রহের খবর পান। কিন্তু নীলমাধবকে দেখাতে বিশ্বাবসু রাজি ছিলেন না। তবে বিশ্বাবসুর কন্যা ললিতা বিদ্যাপতির প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করতে চাইলে বিশ্বাবসু রাজি হন। ললিতার অনুরোধেই শেষ পর্যন্ত বিদ্যাপতির চোখ বেঁধে তাঁকে তিনি একদিন জঙ্গলের মধ্যে নীলমাধবের সামনে নিয়ে যান। কিন্তু পুরা-কথা মতো, নীলমাধবের মূর্তি যিনি দর্শন করবেন, যম তাঁকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তাই বিদ্যাপতির কাছ থেকে খবর পেয়ে অবন্তীরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন সৈন্য সামন্ত নিয়ে মূর্তি দর্শন করতে আসতে চাইলে বিগ্রহটি অন্তর্হিত হয়ে যায়।

ইন্দ্রদ্যুম্ন দুঃখে আত্মহত্যা করতে গেলে, পুরা-কথা মতো, আকাশবাণীতে তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়, বিষ্ণুর দারুব্রহ্ম মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে। বাঙ্কি মুহান নামে একটি জায়গায় সমুদ্রের উপরে স্বপ্নাদেশে সেই কাঠের সন্ধানও পান। অনেকে ব্যর্থ হওয়ার পরে মূর্তি তৈরি করতে আসেন অনন্ত মহারানা নামে এক বৃদ্ধ। ২১ দিন ধরে মন্দিরের দরজা বন্ধ রেখে জগন্নাথের কলেবর তৈরি করবেন বলে কথা দেন। বলেছিলেন, এর মধ্যে দরজা যেন খোলা না হয়। কিন্তু পনেরো দিন পরে রাজা দরজা খুলে দেখেন, বৃদ্ধ নেই। মূর্তিগুলিও অসম্পূর্ণ। পা প্রকট নয়। আঙুল দেখা যায় না। সেই রূপেই জগন্নাথ পতিতপাবন হয়ে এই মন্দিরে বিরাজ করেন।

বিশ্বাবসুর উত্তরসূরিরাই দৈতাপতি। মধ্য যুগের ওড়িশার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ রোল্যাঁ হার্ডেনবার্গ মনে করেন, ‘দৈতা’ শব্দটি এসেছে দৈত্য থেকে। মোটামুটি ভাবে চৈত্রের শুক্লপক্ষের দশমীতে নবকলেবরের উৎসব শুরু। পুরী থেকে কিছু দূরে কাকটপুরে মঙ্গলাদেবীর মন্দিরের কাছ থেকে দৈতাপতিরা নতুন বিগ্রহগুলির কাঠের জন্য নতুন গাছের সন্ধানে বেরোন। গাছগুলিতে কোনও পাখির বাসা থাকা চলবে না, মূলে বিষধর সাপের বাসা থাকতে হবে। থাকতে হবে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মের চিহ্ন। তিন, পাঁচ বা সাতটি করে শাখা থাকতে হবে। জগন্নাথের বিগ্রহ হবে যে গাছের কাঠ থেকে তা হবে কৃষ্ণবর্ণ, বলরামেরটি শ্বেতবর্ণ, সুভদ্রার রক্তবর্ণ। সেই কাঠ কাঠেরই শকটে পুরীতে আনা হয়। সেই শকট কোন গাছের কাঠ থেকে করা হবে, তা-ও নির্দিষ্ট রয়েছে।

মন্দিরে স্নান পূর্ণিমার দিন পুরনো বিগ্রহগুলির স্নান উৎসবের পরে শুরু হয় নবকলেবরের যজ্ঞ। তারপরেই শুরু হয় নতুন মূর্তিগুলির নির্মাণকাজ। সূত সংহিতার নিয়ম মেনে একান্ত গোপনে কৈলী বৈকুণ্ঠে আস্তে আস্তে গড়ে ওঠেন নতুন জগন্নাথ। মূর্তি নির্মাণ শেষ হয় ত্রয়োদশীতে। তখন যজ্ঞেরও পূর্ণাহুতি দেওয়া হয়। এর পরের দিনই নিশীথে ‘ব্রহ্মবস্তু’ জগন্নাথের নতুন কলেবরে স্থাপন করা হয়। পুরনো বিগ্রহগুলি ‘নিষ্প্রাণ’ হয়ে পড়ে। তাদের সমাধি দেওয়া হয় কৈলী বৈকুণ্ঠেই।

‘ব্রহ্মবস্তু’ ঠিক কী, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। যে দৈতাপতিরাও বলতে পারেন না এটি কী। কেউ বলেন, সেটি বুদ্ধের দাঁত। কেউ বলেন, কৃষ্ণের দেহাবশেষ। কৃষ্ণ মারা গিয়েছিলেন এক শবরের তিরে। দ্বারকায়। তাঁর দেহাবশেষ ভাসতে ভাসতে আসে পূর্ব ভারতের সমুদ্রতীরে। পুরাণ মতে, সেখান থেকেই জন্ম নীলমাধবের।

নবকলেবরে প্রধান ভূমিকা দৈতাপতিদেরই। তাঁরাই ‘ব্রহ্মবস্তু’ স্থাপন করেন। কিন্তু মূর্তি সম্পূর্ণ হয় চোখ আঁকার পরে। সেই কাজটি করেন ব্রাহ্মণেরা। বিশ্বাবসু ও বিদ্যাপতির সেই ঐতিহ্য যেন এখনও চলছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement