নরেন্দ্র মোদী
সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে টক্কর দিতে কি মা টেরিজার শরণ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী? নাকি বিশ্বের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার বার্তা দিতে এ নিতান্তই তাঁর কৌশল।
আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার এখনও মা টেরিজার কট্টর সমালোচক। সঙ্ঘের আনুষ্ঠানিক লাইন— মানবতার আড়ালে আসলে ধর্মান্তর করাতেন মা টেরিজা। ৭২ ঘণ্টা পর ভ্যাটিক্যান সিটিতে যখন মাদার টেরিজার সন্ত হয়ে ওঠার অনুষ্ঠান হতে চলেছে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তখন তার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে নেমেছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আন্তর্জাতিক যুগ্ম সাধারণ সচিব সুরেন্দ্র জৈনের কথায়— মাদার টেরিজার সন্ত উপাধি লাভ এ দেশে ধর্মান্তরকেই প্রশ্রয় দেবে। মাদার যখন নোবেল পুরস্কার পান, তখনও সঙ্ঘ তার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত দেখেছিল। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত ২০১৫ সালে রাজস্থানে এক অনুষ্ঠানে ধর্মান্তরের জন্য মাদারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।
এ বার মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও রোমে আমন্ত্রণ জানায়, তখনও আরএসএস চেয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও সরকার বিনীত ভাবে এই অনুষ্ঠান বয়কট করুক। প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় সূত্র বলছে, মোদী সঙ্ঘের সেই প্রস্তাব সটান নাকচ করেছেন। তিনি নিজে যেতে না পারলেও বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলকে রোমে পাঠাচ্ছেন। এই দলে গোয়ার বিজেপি উপমুখ্যমন্ত্রী ফ্রান্সিস ডি’সুজা এবং কে জে অ্যালফোসও থাকছেন। প্রধানমন্ত্রী মিশনারিজ অব চ্যারিটিজকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ওই সময় মিশরের প্রেসিডেন্ট দিল্লি আসায় তিনি যেতে পারছেন না। গত রবিবার ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে মাদারের প্রশংসাও করেছেন তিনি। এমনকী যে নোবেল পুরস্কারের বিরোধিতা করেছিল আরএসএস, সেই পুরস্কারের কথাও উল্লেখ করেছেন নরেন্দ্র মোদী।
প্রশ্ন উঠেছে— এ-সব কি সত্যি সত্যি মোহন ভাগবতের সঙ্গে মোদীর সংঘাত? না কি, নিতান্তই কৌশল?
বিজেপি সূত্র বলছে— আসলে সঙ্ঘ নয়, আমেরিকা তথা পশ্চিমি দুনিয়াকেই বার্তাটা দিতে চাইছেন মোদী। সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায় ভারতে তিন শতাংশের কম হলেও তাঁদের মধ্যে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার তীব্র অভাববোধ আছে। বাজপেয়ীর আমলে ওড়িশার কেওনঝড়ে দুই শিশুপুত্র-সহ যাজক গ্রাহাম স্টেনসকে পুড়িয়ে মারার পরে বিশ্বে তোলপাড় পড়ে যায়। একই ভাবে মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণ হয়েছে। দিল্লির নির্বাচনের সময়ও পুরনো দিল্লির প্রাচীন গির্জাঘরে পাথর ছোড়া হয়।
এই সব ঘটনার নানা প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দিল্লি এসে উদ্বেগ প্রকাশ করতে ছাড়েননি। মোদী সরকারকে সতর্ক পর্যন্ত করেছিলেন তিনি। মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরিও সম্প্রতি দিল্লি এসে সহিষ্ণুতার কথা বলে সঙ্ঘ পরিবারকে বার্তা দিয়েছেন। সেই প্রেক্ষাপটে অনেকে মনে করছেন, মাদার টেরিজার সন্তায়ন উপলক্ষে মোদী একটা ইতিবাচক ভূমিকা নেওয়ার কৌশল নিয়েছেন, এবং সেটা সঙ্ঘ নেতৃত্বও জানেন।
আবার সঙ্ঘ পরিবারের একাংশ মনে করছেন, এই কৌশলে তাঁর সঙ্গে পরিবারের সংঘাত বাড়তে পারে। তাঁদের কথায়, গত দু’বছরে মোদীর জনপ্রিয়তা পড়েছে। বিহারে পরাজয়ের পরে পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশের প্রাক নির্বাচন পরিস্থিতিও বিজেপির কপালে ভাঁজ ফেলেছে। মোদীর কর্তৃত্ব যত দুর্বল হচ্ছে, মোহন ভাগবত তথা আরএসএসের নিয়ন্ত্রণ তত বাড়ছে। ফলে মোদী যতটা মোহন ভাগবতকে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন, এখন ভাগবত তার চেয়েও বেশি মোদীকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।
কাল গোয়ায় যে ভাবে আরএসএসের মধ্যে একটা বিদ্রোহ হয়ে গেল, সেটাও তাৎপর্যপূর্ণ। আরএসএসের গোয়ার প্রধান সুভাষ ভেলিঙ্গকরকে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে প্রায় ৪০০ জন সঙ্ঘ কর্মী ইস্তফা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। আরএসএস নেতৃত্বের বক্তব্য, সুভাষ আলাদা রাজনৈতিক দল গড়তে চেয়েছিলেন বলেই তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিদ্রোহী আরএসএস কর্মীদের মতে, কোঙ্কনি ও মরাঠি ভাষাকে ইংরাজির উপরে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য যে দাবি করা হচ্ছিল, বিজেপি তা অগ্রাহ্য করেছে।
এই পরিস্থিতিতে নিজের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রাখা নিয়ে সঙ্ঘের উপরের স্তরে নেতাদের সঙ্গে মোদীর যতই সমঝোতা থাকুক, নিচু তলায় মোদীর বিরুদ্ধে আরএসএসে যে ক্ষোভ বাড়ছে, সেটি স্পষ্ট।