মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী দলগুলি যখন রাজ্যপালদের ‘অসাংবিধানিক এবং অগণতান্ত্রিক’ আচরণের অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ আন্দোলন তৈরি করতে চাইছে, তাতে শামিল হতে নারাজ তৃণমূল কংগ্রেস। যদিও কিছু দিন আগেও পশ্চিমবঙ্গের তখনকার রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে সব চেয়ে বেশি সংঘাত দেখা গিয়েছিল তৃণমূলের।
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তথা ডিএমকে নেতা এম কে স্ট্যালিনের সঙ্গে ‘উন্নয়ন’, ‘সৌজন্য’ এবং ‘কিছু রাজনৈতিক বিষয়’ নিয়ে গত কালই চেন্নাইয়ে কথা বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তামিলনাড়ুর রাজ্যপালকে সরানোর দাবিতে সমমনস্ক বিরোধী দলগুলিকে হাত মেলানোর যে আর্জি স্ট্যালিন জানিয়েছেন, তাতে সাড়া দিচ্ছে না তৃণমূল কংগ্রেস। রাজনৈতিক সূত্রে এ খবর জানা গিয়েছে। তবে এ ব্যাপারে তৃণমূল পাশে না থাকলেও, আজ কংগ্রেস জানিয়েছে তারা ডিএমকে-র আবেদনে সই করবে। একই ভাবে পাশে থাকার সাড়া দিয়েছে বাম দলগুলিও।
তৃণমূলের এক পদস্থ নেতা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে আজ জানিয়েছেন, “তামিলনাড়ুতে ডিএমকে সরকারের শরিক দল কংগ্রেস। তারা রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রাতেও পাশে রয়েছে। কিন্তু ডিএমকে-র রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই। ডিএমকে আমাদের জোট শরিক নয়। তৃণমূল আগামী লোকসভা নির্বাচনেও রাজ্যের বিয়াল্লিশটি আসনে বিজেপির বিরুদ্ধে একা লড়বে। ফলে ডিএমকে-র সব তালে আমাদের তাল মেলাতে হবে, এমন কোনও কথা নেই।” তৃণমূল নেতৃত্ব মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কয়েক মাস আগে দিল্লিতে ডিএমকে-র নতুন দলীয় অফিস উদ্বোধনের কথা। আমন্ত্রণ সত্ত্বেও সেখানে তৃণমূলের সংসদীয় নেতারা কেউ যাননি। পাঠানো হয়েছিল অপরূপা পোদ্দারকে। পরে তৃণমূল সূত্রে বলা হয়েছিল, ওই অনুষ্ঠানে সর্বাধিক সক্রিয় দেখা গিয়েছিল কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গান্ধীকে, আর সেটাই স্বাভাবিক। কারণ তাঁরা জোট শরিক। সেখানে নাক গলিয়ে ভুল বার্তা দিতে চায় না তৃণমূল। রাজনৈতিক সূত্রের মতে, কংগ্রেসের প্রতি ‘অ্যালার্জি’র বিষয়টিও তৃণমূলকে কিছুটা দূরে রাখছে। সংসদীয় সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও এসপি, আপ বা টিআরএস-এর সঙ্গে সংযোগ রাখতে তৃণমূলকে অনেকটাই স্বচ্ছন্দ দেখা গিয়েছে, কারণ তাদের সঙ্গে কংগ্রেসের কোনও জোট নেই।
গত কালই স্ট্যালিনের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁকে ভ্রাতৃসম বলেছেন মমতা। জানিয়েছেন, রাজনীতির বাইরেও কথা হয়েছে উন্নয়ন নিয়ে। তাঁদের এই সাক্ষাৎকে স্বাভাবিক সৌজন্য হিসাবেও ব্যাখ্যা করছেন তৃণমূলীরা। বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, গোটা দেশেই একটি বড় সংখ্যক ভোটার রয়েছেন, যাঁদের ভোটদানের কোনও পূর্বদিশা থাকে না (ফ্লোটিং)। তাঁরা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সৌজন্য, উন্নয়নমুখিনতা, পারস্পরিক সম্পর্কের দিকটি খুঁজতে চান। সেটিকেই বেশি গুরুত্ব দেন। রাজনৈতিক কচকচানি তাঁরা পছন্দ করেন না। ফলে তৃণমূল নেতৃত্ব সেই ভোটারদের কথাও বিবেচনার মধ্যে রাখছে।”
অন্য দিকে কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম আজ জানিয়েছেন, “তামিলনাড়ুর রাজ্যপালকে ফিরিয়ে নেওয়া সংক্রান্ত ডিএমকে-র আর্জিকে আমরা সমর্থন করি। ডিএমকে-র পাশাপাশি আমরা এবং অন্য শরিক দলগুলি এতে সই করব।” বুধবার ডিএমকে-র লোকসভার নেতা টি আর বালু বিরোধী দলগুলিকে একটি চিঠি দিয়ে তাঁদের পাশে থাকতে আবেদন জানিয়েছিলেন। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের কথায়, “নিজেদের সাংবিধানিক দায়িত্ব মেনে চলা রাজ্যপাল এখন লুপ্তপ্রায়। ২০১৪ সাল থেকে যাঁরা এই পদে নিযুক্ত হয়েছেন, তাঁরা অমর্যাদাকর আচরণ করেছেন। ওই দু’জনের (মোদী-শাহ) সুরে তাঁরা নেচেছেন, এমনকি আগ বাড়িয়েও।” বামদলগুলিও বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্যপালের আচরণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি সাংবাদিক সম্মেলনে আহ্বান জানিয়েছেন, “সমস্ত সমমনস্ক দলগুলি রাজ্যপালদের অসাংবিধানিক এবং অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিবাদ করুক।’’ বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে রাজ্যপালকে বিজেপি রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে বিরোধী দলগুলিকে এক মঞ্চে আনতে চাইছে সিপিএম। বাম শাসিত কেরলের পিনারাই বিজয়ন সরকারের সঙ্গে রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানের সংঘাত এতটাই তিক্ততায় পৌঁছেছে যে সম্প্রতি সিপিআই নেতা ডি রাজা রাজ্যপালের পদটিই বিলুপ্ত করে দেওয়ার দাবি তুলেছেন।
তামিলানাড়ুতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব নেন আর এন রবি, যাঁর নিয়োগ নিয়ে ডিএমকে-সহ শাসক জোটের সমস্ত নেতা আপত্তি জানিয়েছিলেন। রাজ্যের শাসক জোট জানিয়েছিল, বিজেপির রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রবিকে রাজ্যপাল হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। পরবর্তী কালে বিভিন্ন বিষয়ে সংঘাত তীব্র হয়েছে।
ঘটনা হল, উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল ধনখড়ের সঙ্গে চরম সংঘাত চলছে তৃণমূলের। কিন্তু এই মুহূর্তে তারা বিরোধীদের এই সম্মিলিত রাজ্যপাল-বিরোধী আন্দোলনে থাকতে নারাজ।