‘সামনে গুলিবিদ্ধ মানুষগুলো তখন হামাগুড়ি দিয়ে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, আর আমি...’

কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফেরার পথে গ্রামে একটা দোকানের সামনে অনেকেই দাঁড়িয়ে গল্প করেন। বৃহস্পতিবার রাত তখন প্রায় আটটা।

Advertisement

সহদেব নমশূদ্র

খেরবাড়ি (তিনসুকিয়া): শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৮ ১৩:০১
Share:

তিনসুকিয়ার ঘটনায় বেঁচে গিয়েছেন সহদেব নমশূদ্র। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ধলা-শদিয়ার গর্ব ভূপেন হাজরিকা সেতুর অদূরেই আমাদের গ্রাম বিসনিমুখ-খেরবাড়ি। বেশির ভাগ মানুষই শ্রমজীবী। কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফেরার পথে গ্রামে একটা দোকানের সামনে অনেকেই দাঁড়িয়ে গল্প করেন। বৃহস্পতিবার রাত তখন প্রায় আটটা।

Advertisement

ভটভট শব্দে তিনটে মোটরবাইক এসে দাঁড়াল। প্রতিটিতে দু’জন করে লোক। সামরিক পোশাক পরা। মুখে কালো কাপড় বাঁধা। হাতে রাইফেল। প্রথমে সেনা বলে মনে হলেও ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। আমি তখন দোকানের সামনে মোবাইলে গেম খেলছিলাম। ওরা এসে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের ডাকছিল, একে একে। আধো অন্ধকার এলাকা। কী হচ্ছে বুঝতে মোবাইলের টর্চ জ্বালালাম। আমাকেও ডেকে নিল। বলল, কিছু আলোচনা রয়েছে। নিজেদের মধ্যে অসমিয়ায় কথা বললেও ওরা আমাদের সঙ্গে কথা বলছিল হিন্দিতে।

আমাদের নিয়ে ওরা চলল সেতুর তলার দিকে। অন্ধকারে, এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় মোবাইলের টর্চের আলো ফেলতেই ধমকে উঠল এক জন। কেড়ে নিল মোবাইল। সেতুর কাছে পৌঁছে সকলকে বসতে বলল। অনন্ত, অবিনাশরা বসতে চায়নি। তখন রাইফেল উঁচিয়ে সকলকে বসাল ওরা। আর তার পরেই গর্জে উঠল রাইফেল।

Advertisement

আরও পড়ুন: বাঙালিদের উপরে হামলা চালাতে পারে আলফা, সাত দিন আগেই সতর্ক করেছিল দিল্লি!

চিৎকার, রক্তের ছিটে আর ধোঁয়ায় ভরে গেল জায়গাটা। আর কিছু মনে নেই। হুঁশ ফিরতে বুঝলাম, বেঁচে আছি! ভাগ্যিস, গর্ত আর কাঁটাঝোপের মধ্যে ছিটকে পড়ে গিয়েছিলাম। তাই রক্ষে! অন্ধকারে আমাকেও মৃত ভেবে চলে গেল ওরা। আমাদের গ্রামের কাছে চর-চাপড়ি এলাকায় আলফার ঘাঁটি আছে। বাইক নিয়ে সম্ভবত চরের দিকেই গিয়েছিল দলটা।

আমার গলা দিয়ে তখন আওয়াজ বেরোচ্ছে না। দেখলাম, গুলিবিদ্ধ মানুষগুলো বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টায় সামান্য হামাগুড়ি দিয়ে একে একে নিথর হয়ে গেল। অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পরে যখন নিশ্চিত হলাম যে জঙ্গিরা চলে গিয়েছে, বেরিয়ে এসে গ্রামে যাই। গুলির শব্দ পেলেও গ্রামের মানুষ ভাবছিলেন, বাজি ফাটছে। কারণ, আমাদের শান্ত গ্রামে গুলি চলবে, কেউ ভাবতেই পারেননি। গ্রামের মানুষকে নিয়ে এসে দেহগুলো সরাতে গিয়ে দেখি, এক জনের তখনও প্রাণ আছে। তাঁকে ঠেলায় তুলে নিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। কিন্তু জল খাওয়ার পরে রাস্তাতেই মারা গেলেন তিনি।

গত বছর মে মাসে, দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ এই সেতুর উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলা-অসম সম্প্রীতির দূত ভূপেন হাজরিকার নামে সেতুর নামকরণও হয়েছে। তখন থেকে সেতুটা নিয়ে গর্ব আমাদের। কিন্তু রক্তে ভেজা বালিচর, ঘাসজমি এখন আমাদের মনে করিয়ে দেবে, বাঙালি হিসেবে গর্ব নয়, বাঁচতে হবে আতঙ্ককে সঙ্গী করেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement