Tiger

বাঘের হলুদ ডোরা ঢাকছে কালোয়! দুশ্চিন্তা দেশ জুড়ে, কেন এই রূপ বদল? এর নেপথ্যেই বা কী কারণ?

তার কৃষ্ণ-পিঙ্গল আঁকাবাঁকা ডোরা, সেই আদিম রঙের উপরে কে যেন ঘন কালির প্রলেপ এঁকে দিয়েছে। ওড়িশার সিমলিপালে ব্যাঘ্রকুলের এই কৃষ্ণবর্ণ প্রাপ্তিতে কপালে মেঘ জমেছে তামাম বাঘ বিশেজ্ঞদের।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৪ ০৭:৩১
Share:

‘মেলানিস্টিক’ কালো বাঘ। ছবি: সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের সৌজন্যে।

তার গায়ের রং ময়লা হয়ে যাচ্ছে!

Advertisement

দুধে-আলতায় সে যে ধবল ছিল, এমন নয়। তবে তার কৃষ্ণ-পিঙ্গল আঁকাবাঁকা ডোরা, সেই আদিম রঙের উপরে কে যেন ঘন কালির প্রলেপ এঁকে দিয়েছে। ওড়িশার সিমলিপালে ব্যাঘ্রকুলের ক্রমশ এই কৃষ্ণবর্ণ প্রাপ্তিতে কপালে মেঘ জমেছে তামাম বাঘ বিশেজ্ঞদের।

১০ থেকে তারা এখন ১৩। বন কর্তাদের হিসাব বলছে, দু’বছরে সংখ্যা বৃদ্ধি তিন। বাড়বৃদ্ধিতে সচরাচর স্বস্তি মেলে। এ ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো, সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের শাল-পিয়ালের গহীন জঙ্গলে, গোটা ৩৬ বাঘের প্রায় ৩৭ শতাংশই কৃষ্ণবর্ণ হয়ে ওঠায় বাঘের আদি রূপের অস্তিত্ব থাকবে তো, প্রশ্নটা তাড়া করছে দেশের বন কর্তাদের। বাঘ সংরক্ষণে দেশের সর্বোচ্চ সংস্থা এনটিসিএ’র (ন্যাশনাল টাইগার কনজ়ারভেশন অথরিটি) সদস্য সচিব গোবিন্দ ভরদ্বাজ কবুলও করে ফেললেন সে কথা— ‘‘মেলানিজ়ম (কৃষ্ণবর্ণত্ব)-এর ফলে বাঘের আদি চেহারাটাই মুছে না যায়!’’ সে অনিশ্চয়তার হদিশ করতে তাবড় বিশেষজ্ঞরা এখন তড়িঘড়ি সরেজমিন তদন্তে ছুটেছেন সিমলিপালে।

Advertisement

পশ্চিম ভারতের রুখু জঙ্গল কিংবা উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি অরণ্যে অহরহ ব্ল্যাক প্যান্থার বা কালো চিতাবাঘের দেখা মেলে। তার কারণও মেলানিজ়ম। তা বলে, হলুদ-কালো ডোরা কাটা জাতীয় পশুর কৃষ্ণবর্ণ প্রাপ্তি! বাঘ বিশেষজ্ঞ তথা ডব্লুপিএসআই-এর (ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি) ডিরেক্টর বেলিন্ডা রাইটস বলেছেন, ‘‘আপাত ভাবে ব্যাপারটা সুন্দর হলেও প্রাণিজগতের ভারসাম্যের প্রশ্নে কিন্তু এই রূপান্তর খুব কাম্য নয়।’’ তা হলে মেলানিজ়ম রোখার উপায়?

প্রাণিবিজ্ঞানী টিএস মাথুর বলছেন, ‘‘এ এক জিনগত সমস্যা। এর ফলে প্রাণীদের চামড়া কিংবা রোমে কালো রঙের প্রাচুর্য বেড়ে গায়ের আদি রঙটাকেই আড়াল করে দেয়। বাঘের হলুদ ডোরা এ ভাবেই কালোর আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। ব্ল্যাক প্যান্থারের ক্ষেত্রেও কারণটা একই। তাদের হলুদ বর্ণের উপরে চাকা চাকা দাগ কালোর আস্তরণে ঢেকে যায়।’’ সেই সঙ্গে তিনি ধরিয়ে দেন, এর বিপরীত ক্ষেত্রে চামড়ার রং অত্যধিক সাদা হয়ে যাওয়া অ্যালবিনো বা সাদা বাঘের উৎপত্তির কারণ।

কয়েক বছর ধরে কালো বাঘের সুলুক সন্ধান করছেন প্রাণিবিশেষজ্ঞ উমা রামকৃষ্ণান। তাঁর অনুমান, ইনব্রিডিং বা নিকট আত্মীয়তার মধ্যে প্রজননের ফলেই সিমলিপালে কালো বাঘের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত মেলামেশায় বাধ সাধে কার সাধ্য! সিমলিপালের বনকর্তারা জানান, সমগ্র জঙ্গল জুড়ে নয়, ওই ব্যাঘ্র প্রকল্পের নওরঙ্গা রেঞ্জের বড়মকাবাড়ি এলাকাটাই কালো বাঘের ডেরা। ওই নির্দিষ্ট এলাকায় যে ক’টি বাঘ থাকে, মিলন হচ্ছে তদের মধ্যেই। বাঘ বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘বাঘের ইনব্রিডিং বন্ধ করা সহজ নয়। এমনকি ঠিক কোন বাঘের জিনে মেলানিন রয়েছে তা আগাম অনুমান করাও সম্ভব নয়। আবার এ কথাও ঠিক, বাঘিনীর জিনে মেলানিন রয়েছে মানেই পরবর্তী প্রজন্মের সব শাবকের গায়ের রং কালো হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই।’’ ধাঁধাটা এখানেই।

ওড়িশা সরকারের পর্যটন দফতরের অবশ্য এ সব জটিল ধাঁধা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। বরং পর্যটক টানতে গত কয়েক বছর ধরে সিমলিপালের কালো বাঘের ঢালাও প্রচারে নেমেছে তারা। শুরু হয়েছে ‘কালো বাঘ সাফারি’। যা শুনে বাঘ বিশেষজ্ঞ জয়দীপ কুণ্ডুর প্রশ্ন, ‘‘কালো বাঘ কতটা বাস্তব আর কতটা প্রচার সেটাও খতিয়ে দেখার বিষয়! আর মেলানিন ঘটিত কারণে যদি বাঘের গাত্রবর্ণ কালো হয়ে থাকে তবে সে ঘটনা দেশের অন্যত্রও ঘটতে পারে। সজাগ থাকা উচিত সে ব্যাপারেও।’’

বিভিন্ন ট্র্যাপ ক্যামেরা অবশ্য নিছক প্রচারের কথা বলছে না। বরং অন্ধকার রাতে সেই আঁধার কালো রঙ নিয়ে সে বার বার ধরা দিয়েছে ক্যামেরায়। সিমলিপালের এক বনকর্মী বলছেন, ‘‘শুধু রাতে নয়, বনের গভীরে ক্যামেরা বসাতে গিয়ে দুপুরেও দেখেছি তাকে, সে বড় ভয়ঙ্কর রূপ।’’

বন-মুগ্ধ কিপলিং সাহেব বলেছিলেন— ‘তার রূপের ছটায় জঙ্গল বুঝি আরও রূপবতী হয়ে ওঠে!’ সেই পিঙ্গল রূপ কালো-ছায়ায় চিরতরে হারিয়ে যাবে না তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement