আবার বাজেট। চতুর্দিকে মিডিয়ার বাজেটোৎসব। শহুরে শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে বাজেট নিয়ে আশা-আশঙ্কার দোদুল্যমানতা। এ বারে আবার বাজেট একটু এগিয়ে এল। ২০১৯ সালের সাধারণ লোকসভা ভোটের আগে এটাই মোদী সরকারের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। বাজেট ২০১৮-র থেকে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক। আয়কর কমানো থেকে জিএসটি-র সরলীকরণ। স্বাস্থ্য-শিক্ষায় গুরুত্ব থেকে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি। এর মধ্যে দু’টি বিশেষ বিষয়ে আজ এই প্রবন্ধে আমার যুক্তি ও মানুষের আশা নিয়ে মন্তব্য করব। বর্তমানে ডিজেল-পেট্রোলের রেকর্ড দাম আর নারী সংক্রান্ত জেন্ডার বাজেটিং।
গত কয়েক দিন ধরে কলকাতা-সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম ক্রমাগত উর্ধ্বমুখী। পেট্রোল লিটার প্রতি ৭১.৩৯ টাকা ও ডিজেল ৬২.০৬ টাকা দিল্লিতে। কারণ হিসাবে আসছে আন্তর্জাতিক মূল্য বৃদ্ধি অপরিশোধিত তেলের। এখন এক ব্যারল তেলের আন্তর্জাতিক মূল্য প্রায় ৭০ ডলার। সরকারি মুখপাত্র বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে এখন আন্তর্জাতিক মূল্যের সঙ্গে ভারতের তেলের দাম প্রতি দিন ওঠে নামে। কথাটা অর্ধসত্য। মূল্য ওঠে ঠিকই, কিন্তু কমে না। কয়েক মাস আগে যখন বিশ্ববাজারে দাম পড়েছিল, তখনও কিন্তু ভারতের আমজনতা তার সুবিধা পেল না কারণ কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমাগত শুল্ক বাড়িয়ে নিজের কোষাগার ভরিয়ে ফেলল।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হল যে বর্তমানে ৭১.৩৯ টাকা পেট্রোলের দামের মধ্যে অশোধিত তেল আমদানি ও পরিশোধনের পর খরচ মাত্র ৩৩.১৪ টাকা। সঙ্গে যোগ হোক পেট্রোল পাম্প ডিলারদের কমিশন লিটার প্রতি ৩.৬০ টাকা। অর্থাৎ মোট ৩৬.৭৪ টাকা। বাকি ৩৪.৬৬ টাকার সবটাই কিন্তু কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ঘরে জমা করা করের বোঝা। ১৯.৪৮ টাকা কেন্দ্রীয় আবগারি কর আর ১৫.১৮ টাকা রাজ্য ভ্যাট। অর্থাৎ পেট্রোলের প্রতি লিটার দামের মধ্যে ৪৯ শতাংশ হল আমাদের ‘জনদরদী’ গণতান্ত্রিক সরকারগণ দ্বারা আরোপিত। এই অঙ্কটা ডিজেলের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ! আর যে দামে অপরিশোধিত তেল কিনে এখানে পরিশোধন করে বিক্রি করা হয় সেটা হল আন্তর্জাতিক বাজারের আমদানি তুলনীয় দাম (Import Parity Price), যদিও দেশীয় তৈল শোধনকারী কোম্পানিগুলির খরচ আসলে হয় অনেক কম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে দেশীয় কোম্পানিগুলি আন্তর্জাতিক খরচেই হিসাব দেয় ও স্বভাবতই প্রভূত লাভ করে। আইওসিএল বা বিপিসিএল–এর মতো সরকারি কোম্পানিগুলির থেকে সরকার বড় রকমের ডিভিডেন্ড প্রাপ্ত হয়। আর বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে প্রাপ্তিটা না হয় উহ্যই থাকুক!
এমত অবস্থায় কি বাজেটে আশা আছে, সরকার মুখ তুলে তাকাবে আমজনতার দিকে? করের বোঝা কমিয়ে সম্ভাব্য মূল্যবৃদ্ধির হাত থেকে রক্ষা করবে আমাদের? মনে হয় সে আশা দূরস্ত। জিএসটি-র ধাক্কায় গত বছরে পরোক্ষ কর সংগ্রহ ধাক্কা খেয়েছে জোর। অর্থাৎ, পেট্রোল ডিজেলের কর কমিয়ে কোষাগারের উপর আঘাত হানার সাহস দেখানো মুশকিল। এ বিষয়ে আরও সমস্যা হল সমস্ত রাজনৈতিক দলই এই প্রসঙ্গে একে অপরকে আড়াল করে পাছে নিজের দলের অগণতান্ত্রিক কাজটা ধরা পড়ে যায়। আমি কিন্তু এ প্রসঙ্গে মিডিয়ার অংশগ্রহণও বড়ই কম দেখি। যখন বিশেষ সিনেমা দেখানো আর তার বিরোধের খবরে পাতার পর পাতা কাগজ খরচ হয়, তেল এবং তার মূল্যের সঠিক চিত্রটি অনেকটাই অন্তরালে থেকে যায়।
এ বার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নে। অর্ধেক ভারতবাসী, নারী ভারতবাসীর জন্য সরকার কতটা চিন্তিত? জেন্ডার-বাজেটিং-এর তথ্য বলে, গত বছরের তুলনায় ২০১৭-তে নারীকেন্দ্রিক অর্থবরাদ্দ বেড়েছে ১৭ শতাংশ, যা মূল্যবৃদ্ধি দিয়ে সাযুজ্য আনলে হয় ১১ শতাংশ। প্রথমেই আসি ‘বেটি বচাও বেটি পড়াও’ প্রকল্পে। প্রচুর অর্থ বরাদ্দ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু আশ্চর্যের কথা, এই প্রকল্পে এত টাকা কী ভাবে খরচ হবে, তার কোনও সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। গত বাজেটে অর্থমন্ত্রী ‘মহিলা শক্তি কেন্দ্র’ স্থাপনের কথা বলেছিলেন। এর আওতায় থাকা ১৪ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ হয় ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, প্রতি কেন্দ্রের জন্য ৩৫৭১ টাকা সাকুল্যে। তাতে ঠিক কী ধরনের বিকাশ ঘটানো সম্ভব সেটা বোঝা দুষ্কর।
মহিলা সুরক্ষার জন্য ‘নির্ভয়া ফান্ড’ তৈরি করে কংগ্রেসে সরকার। ২০১৭ সালে এই তহবিলের বরাদ্দ বৃদ্ধি হয় ৯ গুণ। কিন্তু, পুরোটাই খরচ করার কথা বলা হয় বিভিন্ন জায়গায় সিসিটিভি লাগানোর জন্য ও মহিলাদের নিজের সুরক্ষা বাড়ানোর জন্য তালিমের কাজে। কিন্তু, এ সবই হল মহিলা সুরক্ষা বিঘ্নিত হলে কী করতে হবে তার উপর। মহিলা সুরক্ষা বৃদ্ধি করতে সমাজে সচেতনতা বাড়ানোর কোনও প্রচেষ্টা এই খাতে বরাদ্দ করা হয়নি। বরং, পুলিশ বিভাগে মহিলাদের জন্য মোট বরাদ্দ ১০৪ কোটি থেকে কমিয়ে ৩১ কোটি টাকা করা হয়েছে আর মহিলা হেল্পলাইনে টাকার বরাদ্দ তলানিতে ঠেকেছে।
সবশেষে বলি মাতৃস্বাস্থ্য উন্নতির জন্য ঘোষণা করা হয় মাতৃত্ব সহোগ যোজনা যাতে প্রত্যেক গর্ভবতী মা পাবেন ৬০০০ টাকা মাতৃকালীন সব পরিষেবা গ্রহণ করলে। কিন্তু, জননী সুরক্ষা যোজনা ও খাদ্য সুরক্ষা আইন মোতাবেক এই বরাদ্দ আগে থেকে পাওয়া যেত। নতুন সংযোজন হল এই টাকা সরাসরি মহিলার জনধন যোজনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে চলে যায়। স্কিল ইন্ডিয়া-র মাতামাতির মধ্যে বরাদ্দ কমেছে মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে মহিলাদের জন্য।
অর্থাৎ ১লা ফেব্রুয়ারির আসন্ন বাজেটে এক দিকে মোদী সরকারের কাছে প্রবল প্রত্যাশার চাপ থাকবে তেলের দাম কমানোর জন্য করের বোঝা কমানোর, চাপ থাকবে ঘোষিত নীতি হিসাবে মহিলাদের জন্য বিশেষ কিছু প্যাকেজ বা বরাদ্দ নেওয়ার— যা প্রকৃত অর্থে মহিলাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সুরক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সহায়ক হতে পারবে। জনদরদী চমক না হোক, ‘সবকা বিকাশ’-এর জন্য এই দিক দু’টির দিকে নজর রাখার দাবি থাকুক আমজনতার পক্ষ থেকে।