বহু প্রশ্নের জালে যোজনা কমিশনের বিকল্প

যোজনা কমিশন তুলে দিয়ে বিকল্প সংস্থা গড়ার কথা প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন প্রায় চার মাস হতে চলল, এখনও তা ঝুলে হাজারো প্রশ্ন ও নানা আপত্তির জালে। কাজেই খুব তাড়াতাড়ি যে এই কাজটা করে ফেলা সম্ভব নয়, সেটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মৌলিক যে পরিবর্তনটি আনতে চাইছেন, সেটা তিনি আজ স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে। বিজেপি ও তাদের সহযোগী দলগুলির মুখ্যমন্ত্রীরা বাদে অনেক রাজ্যই অবশ্য বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছে ওই বৈঠকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:১০
Share:

যোজনা কমিশনের বৈঠকে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শুভেচ্ছা বিনিময়। রয়েছেন অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও। রবিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

যোজনা কমিশন তুলে দিয়ে বিকল্প সংস্থা গড়ার কথা প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন প্রায় চার মাস হতে চলল, এখনও তা ঝুলে হাজারো প্রশ্ন ও নানা আপত্তির জালে। কাজেই খুব তাড়াতাড়ি যে এই কাজটা করে ফেলা সম্ভব নয়, সেটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মৌলিক যে পরিবর্তনটি আনতে চাইছেন, সেটা তিনি আজ স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে। বিজেপি ও তাদের সহযোগী দলগুলির মুখ্যমন্ত্রীরা বাদে অনেক রাজ্যই অবশ্য বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছে ওই বৈঠকে। রাতারাতি তার সব উত্তর দেওয়া সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয়। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আরও আলোচনা হবে। তার পরেই সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু কত দিনের মধ্যে সেই প্রক্রিয়া শেষ হবে, তার কোনও জবাব জেটলি দিতে পারেননি।

Advertisement

মোদী এ দিন মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে তুলে ধরেন, কোথায় আলাদা হবে, তাঁর প্রস্তাবিত যোজনা কমিশনের বিকল্প সংস্থাটি। এত দিন দেশের আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করতেন পদাধিকার বলে যোজনা কমিশনের অধ্যক্ষ প্রধানমন্ত্রী, কমিশনের উপাধ্যক্ষ ও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ মিলে। নতুন যে বিকল্প সংস্থাটি তৈরি হবে তাতে প্রধানমন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞরা যেমন থাকবেন, তেমনই থাকবেন বিভিন্ন রাজ্যের মুূখ্যমন্ত্রী ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের পেশাদাররা। দেশের এতগুলি রাজ্য। সেগুলির মুখ্যমন্ত্রীরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার পাবেন। যোজনা কমিশনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গিয়েছে খাতায় কলমে অনেকে অনেক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হলেও বাস্তবে কোনও ভাবনার প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে পেশাদারিত্বের প্রয়োজন সেটা তাঁদের অনেকের মধ্যে থাকে না। ফলে অনেক প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি ও বাস্তবায়নে খামতি থেকে যায়।

এই প্রতিষ্ঠান কবে থেকে কাজ শুরু করবে, তা অবশ্য এখনই বলতে পারছে না সরকার। ১৫ অগস্ট লাল কেল্লা থেকে তাঁর প্রথম বক্তৃতায় মোদী ঘোষণা করেছিলেন, জওহরলাল নেহরুর আমলের যোজনা কমিশন তুলে দেওয়া হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি হবে নতুন প্রতিষ্ঠান। যেখানে রাজ্যের হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা থাকবে। রাজ্যগুলির মতামত নিয়েই উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি হবে। ১৫ অগস্টই দেশকে সাফসুতরো রাখা, শৌচালয় বানানোর মতো অভিযান শুরুর ঘোষণা করেছিলেন মোদী। তার কাজও শুরু হয়েছে। কিন্তু যোজনা কমিশনের বিকল্প গড়ার মতো বড়সড় ঘোষণা করে দিয়ে সরকার এখন বুঝতে পারছে, অনেক ধাঁধার সমাধান প্রয়োজন। রাজ্যকে প্রতিনিধিত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও নানা বিষয়ে আপত্তি উঠে আসছে রাজ্যগুলি থেকেই। ফলে রাতারাতি যা মিটিয়ে ফেলাও সম্ভব নয়।

Advertisement

এ বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে তুলতেই মুখ্যমন্ত্রীদের আজ বৈঠক ডেকেছিলেন মোদী। রাজ্যকে আরও বেশি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে সব মুখ্যমন্ত্রীই। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যোজনা কমিশন বা জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে এসে মোদী নিজেও সে কথা বলতেন। আজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ই আমার মনে হয়েছিল অপেক্ষাকৃত ভাল মঞ্চ দরকার। যেখানে রাজ্যগুলি নিজেদের মতামত আরও ভাল করে জানাতে পারবে। মন থেকে আমি এখনও মুখ্যমন্ত্রীদেরই সঙ্গে আছি।”

কিন্তু সব মুখ্যমন্ত্রীর মন গলেনি তাতে। কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীরা দাবি করেন, যোজনা কমিশনকেই ঢেলে সাজা হোক। দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাঝে কী ভাবে যোজনা কমিশন তুলে দেওয়া হবে? তাঁদের মতে, রাতারাতি যোজনা কমিশন তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক। উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ যাদবের দাবি, রাজ্যকে উন্নয়নের অর্ধেক অর্থ দিয়ে দেওয়া হোক। নীতীশকুমার এত দিন রাজ্যের হাতে বেশি ক্ষমতার দাবিতে সরব থাকলেও বিহারে তাঁর উত্তরসূরি জিতন রাম মাঁঝির দাবি, এখনই যোজনা কমিশন তুলে দেওয়ার সময় আসেনি। বরং জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠক ডাকা হোক। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির পাশাপাশি তামিলনাড়ু, অন্ধ্র ও তেলঙ্গানার দাবি, যোজনা কমিশন আজই ভেঙে দেওয়া হোক। মোদীকে লেখা চিঠিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি তুলেছেন, আন্তঃরাজ্য পরিষদকে যোজনা কমিশনের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হোক। ত্রিপুরার কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের দাবি, যোজনা কমিশনের মূল ভাবনা বদলে ফেলা ঠিক নয়।

মোদী দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের কথা বলে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও তিনি রাজ্যগুলিকে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়ারই পক্ষে। তাঁর মন্ত্র, ‘কোঅপারেটিভ ফেডেরালিজম’ বা সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। সম্ভবত তেমন একটা আবহ তৈরির ভাবনা থেকেই বিজ্ঞান ভবনে নয়, এ দিনের বৈঠকটি ডেকেছিলেন ৭ নম্বর রেস কোর্স রোডে তাঁর বাসভবনের ‘পঞ্চবটী’ হলে।

মধ্যাহ্নভোজনের পর ঘরোয়া আলোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে। বেধে দেওয়া কোনও আলোচ্যসূচি ছিল না তাতে। ছিলেন না আমলারাও। তবে তার আগে কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের বিরোধিতার জবাবে সুকৌশলে তিনি হাতিয়ার করেন মনমোহন সিংহকে। কারণ, ইউপিএ-জমানার শেষ লগ্নে যোজনা কমিশনে তাঁর শেষ বৈঠকে মনমোহন নিজেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, এই সংস্থা এখনও পুরনো পদ্ধতিতেই কাজ করে যাচ্ছে না তো? কমিশনের নতুন ভূমিকা কী হওয়া উচিত? জোট সরকারের রাজত্বে যোজনা কমিশনকে ঐকমত্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে বলে মত দিয়েছিলেন মনমোহন। মোদী যুক্তি দেন, তাঁর পূর্বসূরি দীর্ঘদিন যোজনা কমিশনের সঙ্গে যুক্তি ছিলেন। তিনিই বলেছিলেন, উদারীকরণের পরে যোজনা কমিশনের সামনে আর কোনও ভবিষ্যৎ রূপরেখা নেই।

আজ মোদী নতুন প্রতিষ্ঠানের যে রূপরেখা দিয়েছেন তার মোদ্দা কথা হল, যোজনা কমিশনের ঠান্ডা ঘরে বসে আর উন্নয়নের প্রকল্প তৈরি হবে না। দিল্লিতে তৈরি পরিকল্পনা রাজ্যের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হবে না। তার বদলে রাজ্যগুলির পরামর্শ মেনে উন্নয়নের প্রকল্প তৈরি হবে। মোদীর ভাষায়, ‘টপ টু বটম’-এর বদলে ‘বটম টু টপ’-এর নীতি মানা হবে। তাঁর বক্তব্য, ‘টিম ইন্ডিয়া’ হল তিনটি টিমের সংমিশ্রণ। প্রথম টিমে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, দ্বিতীয়টিতে প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা, তৃতীয় টিমটি হল প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্র-রাজ্য আমলাদের। এই ‘টিম ইন্ডিয়া’-ই দেশের প্রশাসন চালায়।

আজ মুখ্যমন্ত্রীদের সামনে যোজনা কমিশনের সচিব সিন্ধুশ্রী খুল্লার নতুন সংস্থার ভূমিকা ও এক্তিয়ার নিয়ে চারটি প্রশ্ন রাখেন। এর পাশাপাশি সরকারের তরফে এটা বুধিয়ে দেওয়া হয় নতুন প্রতিষ্ঠান মূলত ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ হিসেবে নয়া নীতি নির্ধারণে সাহায্য করবে। মোদীর যুক্তি, আমেরিকার মতো উন্নত দেশে এই সব থিঙ্ক ট্যাঙ্ক নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এ থেকে স্পষ্ট, কোন রাজ্য উন্নয়ন বাবদ কত অর্থ পাবে, তা ঠিক করার ক্ষমতা নতুন প্রতিষ্ঠানটির হাতে থাকছে না। সেই দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে অর্থ মন্ত্রকের হাতে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement