‘গডম্যান’ চন্দ্রস্বামী। ছবি: সংগৃহীত।
গত দু’দশক ধরেই দিল্লিতে বসবাস। কিন্তু, রাজধানীতে থাকলেও আশি বা নব্বইয়ের দশকের মতো ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরা ছিল না তাঁর। বুধবার প্রয়াত হলেন সেই স্বঘোষিত গডম্যান চন্দ্রস্বামী। বয়স হয়েছিল ৬৯।
দিল্লির এক হাসপাতালে মারা গেলেন চন্দ্রস্বামী। শেষ সময়ে দেহের একাধিক যন্ত্র বিকল হয়ে গিয়েছিল তাঁর। সম্প্রতি স্ট্রোক হয়েছিল। কিডনির সমস্যাতেও ভুগছিলেন। চলছিল ডায়ালিসিসও। খানিকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেই বিদায় নিলেন এক সময়কার রাজনৈতিক শক্তিধরদের ‘কাছের মানুষ’ চন্দ্রস্বামী।
এক সময় দেশ-বিদেশের নানা পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত দেখা যেত চন্দ্রস্বামীকে। সঙ্গে কোনও না কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। লম্বা ঝুলের সাদা পাঞ্জাবি, এলোমেলো চুল-দাড়ি, কপালে মস্ত গোল টিপ, গলায় একাধিক রুদ্রাক্ষ ও সোনার মালা, এক হাতে ধরা লাঠি, রাশভারী চেহারার চন্দ্রস্বামীকে প্রায়শই দেখা যেত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও বা চন্দ্রশেখরের সঙ্গে। শুধু তাঁরাই নন, রাজীব গাঁধী বা তারও আগে ইন্দিরা গাঁধীরও ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন তিনি। তবে পি ভি নরসিংহ রাও বা চন্দ্রশেখরের সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা নাকি সবচেয়ে বেশি ছিল।
প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গেও একাধিক বার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর। এক সময় এমন প্রচারও ছিল যে, নিজের ‘তান্ত্রিক’ ক্ষমতাবলেই রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণে থ্যাচারকে সাহায্য করেছিলেন চন্দ্রস্বামী। সে সব ঠিক না হলেও, দেশ-বিদেশের অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই তাঁর ওঠাবসা, দহরম মহরম ছিল। সে তালিকায় রয়েছেন ব্রুনেই বা বাহারাইনের তৎকালীন সুলতান, হলিউড অভিনেতা এলিজাবেথ টেলর থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ী আদনান খাশোগি, ব্রিটিশ ব্যবসায়ী রোলান্ড রাওল্যান্ড, আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিম। সে সময় চন্দ্রস্বামীর অগাধ ক্ষমতা। তাঁর অঙ্গুলিহেলনে নাকি ক্যাবিনেটে মন্ত্রীদের জায়গাবদলও হত। আমলাদের বদলি বা বড়সড় ব্যবসায়িক চুক্তিও নাকি গড়ে উঠত তাঁর ইশারাতে। তবে এই ‘ঘনিষ্ঠতা’ই চন্দ্রস্বামীর বিপত্তি বাড়িয়েছিল। এবং শেষমেশ তাঁর পতনেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন
ফারুককে জিপে না বাঁধলে আরও রক্তপাত হত, দাবি সেই মেজরের
দেশ-বিদেশের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই ওঠাবসা ছিল চন্দ্রস্বামীর।
১৯৯৬-এ ভারতীয় বংশোদ্ভূত লন্ডনের এক ব্যবসায়ী লখুভাই পাঠককে ১ লক্ষ ডলার প্রতারণা করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় চন্দ্রস্বামীকে। ‘পিকল কিঙ্গ’ নামে পরিচিত লখুভাইয়ের দাবি ছিল, ওই টাকা আসলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের জন্য। এবং সে কারণেই তা চন্দ্রস্বামীকে দেওয়া হয়েছিল। যদিও পরে সে মামলায় অভিযোগ থেকে রেহাই মেলে নরসিংহ রাওয়ের। সে সময় একাধিক আর্থিক দুর্নীতিতে নাম জড়িয়ে পড়েন চন্দ্রস্বামী। ইরান-কন্ট্রা অস্ত্র কেলেঙ্কারিতে তাঁর বিরুদ্ধে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় আইন (ফেরা) ভাঙার অভিযোগ ওঠে। তবে গডম্যানের জীবনে সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায় শুরু হয় বোধহয় ১৯৯৭-এ। রাজীব গাঁধী হত্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে কংগ্রেস। সে মামলায় জৈন কমিশনের রিপোর্টেও তাঁর জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়টি উল্লেখিত ছিল। সেন্ট কিটস জালিয়াতি মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। ষড়যন্ত্র লিপ্ত থেকে তথ্য জালিয়াতি করে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিংহের ছেলে অজেয় সিংহকে ফাঁসানোর অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। ২০০৪-এ অবশ্য সে অভিযোগ থেকে মুক্তি পান চন্দ্রস্বামী।
এক সময় রাজনৈতিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে থাকলেও চন্দ্রস্বামীর প্রথম জীবনের সম্পর্কে বিশেষ কিছু প্রকাশ্যে আসেনি। ১৯৪৮-এ রাজস্থানের বেহরোরে এক মহাজনের ঘরে জন্ম তাঁর। নেমি চন্দ তখনও চন্দ্রস্বামী হয়ে ওঠেননি। রাজস্থানের পাঠ চুকিয়ে নেমি চন্দ্রের পরিবার চলে যায় হায়দরাবাদে। চন্দ্রস্বামীর দাবি ছিল, যৌবনে বিহারের জঙ্গলে ধ্যান করে কাটিয়েছেন তিনি। সে সময়ই তান্ত্রিক ক্ষমতারও অধিকারী হন বলে দাবি তাঁর। তবে কী ভাবে তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের কাছাকাছি এলেন বা ক্ষমতার অলিন্দে ঢুকে পড়লেন তা নিয়ে কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য মেলে না। ২০১৩-তে প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী নটবর সিংহ জানিয়েছিলেন, ১৯৭৫-এ তাঁর সঙ্গে লন্ডনে দেখা হয় চন্দ্রস্বামীর। সে সময় ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার হিসাবে লন্ডনে ছিলেন নটবর। ইন্দিরা গাঁধীর বিশ্বস্ত যশপাল কপূরের সুপারিশেই চন্দ্রস্বামী তাঁর সঙ্গে দেখা করেন বলে দাবি ছিল নটবরের। তবে তার সত্যতা যাচাই হয়নি।
১৯৯৬-এ পাটিয়ালা কোর্টের পথে চন্দ্রস্বামী। ছবি: সংগৃহীত।
জীবনের শেষ দিনগুলির বেশির ভাগ সময় দিল্লিতেই কাটিয়েছিলেন চন্দ্রস্বামী। ইন্দিরা গাঁধী সরকারের তরফে দিল্লির কুতুব ইন্টারন্যাশনাল এলাকায় একটি জমি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। গত দু’দশকে মিডিয়ার চোখের আড়ালেই কেটে গিয়েছে তাঁর। এক সময়ের নিয়মিত শিরোনামে থাকা গডম্যান চন্দ্রস্বামী অবশ্য চলে গেলেন প্রায় সকলের চোখের আড়ালেই।