ফের সেই ১৪ মার্চ। তারিখটা আবার প্রবল তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে। ১৫ বছর আগে এই তারিখেই কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রবল ধাক্কা দিয়ে মমতা টালামাটাল করে দিয়েছিলেন দিল্লির ক্ষমতার ভরকেন্দ্রকে। সোমবার সেই একই তারিখে একই রকম ধাক্কা ফিরে এল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকেই।
২০০১ সাল। ১৩ মার্চ। তহলকা ডট কম নামে একটি ওয়েবসাইট প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বিপুল আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলে স্টিং ভিডিও প্রকাশ করল। তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ, বিজেপি সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণ, সমতা পার্টির সভানেত্রী জয়া জেটলির বিরুদ্ধে বিপুল ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল সেই ভিডিওতে। উত্তাল হয়েছিল গোটা দেশ। ১৪ মার্চ সন্ধ্যায় শাসক জোট এনডিএ-র বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠক বয়কট করেন। দেশজুড়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল সেই ১৪ মার্চ— জর্জ ফার্নান্ডেজকে পদত্যাগ না করানো হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্ত্রিসভা ছেড়ে দেবেন। বাজপেয়ী সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করবে তৃণমূল।
১৫ মার্চ জর্জ ফার্নান্ডেজ পদত্যাগ করেন। সমতা পার্টির সভানেত্রী পদ থেকে জয়া জেটলিও পদত্যাগ করেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাও মন্ত্রিসভা তথা এনডিএ-তে ধরে রাখতে পারেননি বাজপেয়ী। ১৬ মার্চ, ২০০১ মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে, এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন মমতা। তাঁর দাবি মেনে জর্জের অপসারণ সত্ত্বেও বাজপেয়ীর সরকারে থাকেননি মমতা। দুর্নীতির দাগ লেগেছে যে সরকারের গায়ে, তার সঙ্গে আর কিছুতেই নিজের নামকে বোধ হয় জড়াতে চাইছিলেন না মমতা।
১৫ বছর কেটে গিয়েছে সেই ঘটনার পর। কেন্দ্রে আবার সেই এনডিএ সরকার। আর বাংলায় মুখ্যমন্ত্রীর মসনদে মমতা। সেই ১৩ মার্চ তারিখেই প্রকাশিত হল নারদ নিউজ ডট কমের স্টিং অপারেশন ভিডিও। তৃণমূলের ডজনখানেক শীর্ষ নেতাকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাত পেতে নিতে দেখা গিয়েছে ভিডিওতে। কোনও একটি বাণিজ্যিক সংস্থাকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা নিচ্ছেন মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, মেয়র, যুবনেতা, দলের ঘনিষ্ঠ আইপিএস। নারদ নিউজ প্রকাশিত ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে তেমনই।
আরও পড়ুন:
নারদের স্টিং অপারেশন, ঘুষ বিতর্কে জড়ালেন তৃণমূলের ১১ শীর্ষ নেতা
নারদ-কাণ্ডে একযোগে মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করলেন বিরোধীরা
মমতা এখনও নীরব, তৃণমূল বলল জাল ভিডিও! অভিযুক্তরা কী বলছেন?
গোটা দেশে বিতর্কের ঝড় আছড়ে পড়েছে। সবক’টি বিরোধী দল একযোগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করেছে। সিপিএমের দাবি, দরকার হলে ভোট পিছিয়ে যাক। রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হোক বাংলায়। তদন্তের মুখে দাঁড় করানো হোক বাংলার শাসকদের।
১৫ বছর আগে স্টিং ভিডিও দেখেই দেশজুড়ে ইস্তফার বান ডাকিয়ে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জর্জ ফার্নান্ডেজ, বঙ্গারু লক্ষ্ণণ, জয়া জেটলিরা পদত্যাগে বাধ্য তো হয়েইছিলেন। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। দুর্নীতির ‘প্রতিবাদে’ পদত্যাগ করে দিল্লি ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন মমতাও। বাংলার বিধানসভা নির্বাচন তখন সামনেই। এ রাজ্যে দুর্বল বিজেপিকে ছেড়ে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী কংগ্রেসের হাত ধরার সুযোগটাও পেয়ে গিয়েছিলেন মমতা।
১৫ বছর আগের ১৪ মার্চ তারিখে স্টিং ভিডিও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল মমতার কাছে। কিন্তু এ বারের স্টিং ভিডিওকে তিনি সম্ভবত একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না। সব দিক থেকে ইস্তফা, ইস্তফা রব ওঠা সত্ত্বেও, মমতা এবং তৃণমূল অবিচল।
পুনশ্চ: ১৪ মার্চ তারিখটা আরও এক বার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল মমতার কাছে। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ। সে দিন নন্দীগ্রামে গুলি চালিয়েছিল বাম সরকারের পুলিশ। মোড় ঘুরে গিয়েছিল মমতার রাজনৈতিক জীবনের। এই ১৪ মার্চও কি তেমনই কিছু হয়ে উঠবে? উত্তর দেবে সময়।