আরতি অগ্রবাল
বন্ধুদের সঙ্গে পার্টিতে যাওয়ার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কলেজপড়ুয়া তরুণীর মনে হয়েছিল, কোমরের রেখাটা আরও একটু স্পষ্ট করলে হয় না!
সদ্য মা হওয়া এক যুবতী পছন্দের সালোয়ারটা পরতে গিয়ে টের পেলেন, গায়ে চেপে বসছে জামাটা।
সম্প্রতি এমনই দু’জন ‘রোগী’ পেয়েছিলেন শহরের এক প্লাস্টিক সার্জন। লাইপোসাকশন করে মেদ ঝরিয়ে দু’জনেই এখন খুশি।
যদিও সবার সঙ্গে কিন্তু এমনটা না-ও ঘটতে পারে। ঠিক যেমনটা হয়েছে তেলুগু ছবির অভিনেত্রী আরতি অগ্রবালের সঙ্গে। লাইপোসাকশন করাতে আমেরিকা গিয়েছিলেন তিনি। নিউ জার্সিতে অস্ত্রোপচারের পর থেকেই দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট-সহ একাধিক উপসর্গ। মাসখানেক হাসপাতালে থাকার পরে শনিবার হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন আরতি।
অথচ রুপোলি জগতে লাইপোসাকশন বা চর্বি ঝরানোর অস্ত্রোপচার নতুন কোনও ঘটনা নয়। হলিউডের ব্রিটনি স্পিয়ার্স কিংবা ডেমি মুর আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারিণী হয়েছিলেন এই পদ্ধতিতেই। পিছিয়ে নেই বলিউডও। শোনা যায় শ্রীদেবী বা ঐশ্বর্যা মেদ ঝরিয়েছেন এ ভাবেই। তবে কী এমন ঘটল আরতির সঙ্গে?
কলকাতার একাধিক চিকিৎসকের অনুমান, অস্ত্রোপচারের পর চর্বির কিছু অংশ ধমনী বা ফুসফুসে ঢুকে মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে তাঁর। বছর কয়েক আগে এই শহরেই এমন ভাবে এক রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলছেন, অস্ত্রোপচারের অনেক দিন পরে মৃত্যু হয়েছে আরতির। সে ক্ষেত্রে সংক্রমণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ডাক্তারদের তাই সতর্কবার্তা, মেদ ঝরিয়ে রোগা হওয়ার ফ্যাশন এখন যতই ‘ইন’ হোক না কেন, তার জন্য যথেষ্ট সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন! তা না হলে বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, আরতিকে লাইপোসাকশন করাতে বারণই করেছিলেন হায়দরাবাদের চিকিৎসকেরা। তার পরেও চটজলদি রোগা হতে মরিয়া আরতি নিউ জার্সিতে গিয়ে অস্ত্রোপচার করানোর সিদ্ধান্ত নেন।
চিকিৎসকেরা বলছেন, চর্বি কমাতে দু’ধরনের অস্ত্রোপচার রয়েছে। থাই, কোমর বা শরীরের অন্য কোনও জায়গা থেকে চর্বি কমানোর জন্য লাইপোসাকশন সার্জারি করা হয়। এতে ৪-৫ কিলোগ্রাম চর্বিকে টেনে করে বের করা হয়। আর স্থূলতা কমানোর জন্য আছে বেরিয়াট্রিক সার্জারি। এতে পাকস্থলী ও অন্ত্রের ভিতর থেকে চর্বি বের করা হয়। চিকিৎসকদের মতে, দু’টি অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেই সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন। তবে নিয়ম না মেনে এগোলে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন না তাঁরা। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব এস্থেটিক প্লাস্টিক সার্জনস’-এর সভাপতি তথা শহরের অন্যতম বিশিষ্ট প্লাস্টিক সার্জন মনোজ খন্না বলছেন, ‘‘গোটা বিশ্বে লাইপোসাকশন নিরাপদ বলেই স্বীকৃত।’’ শহরের বিশিষ্ট বেরিয়াট্রিক সার্জন বিষ্ণুকুমার ভারতীয়া বলছেন, বেরিয়াট্রিক সার্জারির ক্ষেত্রে রোগীকে ২২ রকম পরীক্ষা করানো হয়। তার পর একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মিলে সেই রিপোর্ট খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেন, অস্ত্রোপচার সম্ভব কি না।
শহরের একটি হাসপাতালের বেরিয়াট্রিক সার্জারির অ্যানাস্থেটিস্ট তাপস চক্রবর্তীও বলছেন, লাইপোসাকশন বা বেরিয়াট্রিক সার্জারির ক্ষেত্রে রোগীর ডায়াবেটিস, রক্তচাপ বা শ্বাসনালীর রোগ রয়েছে কি না, তা দেখে নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলি নিয়ন্ত্রণে এনে অস্ত্রোপচার করতে হয়। লাইপোসাকশন বড় মাপের অস্ত্রোপচার না হলেও প্রয়োজনে রোগীকে নজরে রাখতে হয়।
শহরের কসমেটিক ও প্লাস্টিক সার্জনরা বলছেন, ফিল্মি দুনিয়ার তারকা কিংবা বেঢপ চেহারার পুরুষ-মহিলারাই শুধু নন, ইদানীং মেদহীন ছিপছিপে শরীর পেতে হাজির হচ্ছেন ছাত্রী-গৃহবধূরাও। পিছিয়ে নেই পুরুষেরা। মনোজ খন্না বলছেন, তাঁর কাছে আসা প্রতি তিন জন রোগীর এক জন পুরুষ। কসমেটিক ও প্লাস্টিক সার্জনরা গড়ে ৫-১০টি লাইপোসাকশন করেন প্রতি মাসে।
কিন্তু ব্যায়ামের বদলে অস্ত্রোপচারে ঝুঁকছেন কেন সবাই? চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, শরীরচর্চা করে মেদ ঝরানো পরিশ্রমসাপেক্ষ। সেই মানসিকতা সবার থাকে না। প্লাস্টিক সার্জন অরিন্দম সরকারের মতে, লাইপোসাকশন অনেক ক্ষেত্রেই শরীরের বিভঙ্গ বা রূপ ফেরানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। যা সব সময় ব্যায়াম করে সম্ভব নয়। অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিক বলছেন, ‘‘যোগাসন, ব্যায়াম বা সুষম ডায়েট সব সময়েই বেশি কার্যকর। তবে থাইরয়েড বা ওবেসিটি থাকলে তাতে কাজ হয় না।’’ তবে কোয়েল মনে করেন, এ সব ক্ষেত্রে আগে সফল হয়েছেন, এমন ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই অস্ত্রোপচারের জন্য এগোনো উচিত। সহমত অভিনেত্রী অপরাজিতা আঢ্যও। তাঁর কথায়, ‘‘অ্যাপেন্ডিসাইটিস-এর মতো অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে মারা গিয়েছে, এমনও শুনেছি। কাজেই দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই।’’