অন্য মহিলার গর্ভ ভাড়া করে সন্তানের বাবা-মা হওয়ার ফ্যাশনে রাশ টানতে গিয়ে এখন বড়সড় প্রশ্নের মুখে পড়ল খোদ কেন্দ্রীয় সরকারই।
কারণ, নিঃসন্তান দম্পতির জন্য একটুখানি জানলা খুলে রাখলেও বঞ্চনার তালিকাটি সুদীর্ঘ। সেখানে বাদ সমকামীরা। বাদ পড়েছেন লিভ-ইন সম্পর্কে থাকা মানুষ। বাদ সিঙ্গল পেরেন্টও। আর সেখানেই প্রশ্ন উঠছে নৈতিকতার। পরিবার কাকে বলে, তা কী করে ঠিক করে দিতে পারে সরকার? সন্তানকে বড় করার ক্ষমতা কাদের আছে, কাদের নেই সেটিও কী করে বাতলে দিতে পারে সরকার পক্ষ? গতকাল ঢাকঢোল পিটিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভা ‘সারোগেসি’ নিয়ে যে বিলের খসড়াটি দেশের সামনে নিয়ে এল, তার পিছনে উদ্দেশ্য মহৎ হলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, এই বিল কি আদৌ ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রগতিশীল? না কি এটি আরও প্রত্যাবর্তী বিল?
গত এপ্রিলেই এই বিলের একটি খসড়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তা নিয়ে মন্ত্রীদের মধ্যেই প্রবল বিরোধ ছিল। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের অধীনে একটি মন্ত্রিগোষ্ঠী গঠন করে দেন। সেই মন্ত্রিগোষ্ঠীর সুপারিশের ভিত্তিতে গতকাল মন্ত্রিসভা হুবহু বিলের খসড়াটি অনুমোদন করে ফেলে। দেশের সামনে এই খসড়া তুলে ধরতে খোদ সুষমাকেই সামনে আসার অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এর পরে খোদ মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যেই বিরোধ মেটেনি। মন্ত্রিসভার এক সদস্য আজ বলেন, ‘‘এই বিলে এখনও অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। অনেক বড় অংশকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে এই নিয়ে দেশজুড়ে আরও বিতর্ক হওয়া উচিত। আমি নিশ্চিত, এটি যখন সংসদের স্থায়ী কমিটির কাছে আসবে, তখন সব দলের সাংসদ এর খুঁটিনাটি দিকগুলি বিবেচনা করে দেখবেন।’’
আরও পড়ুন: টাকা দিয়ে সারোগেসি বন্ধই করছে নয়া বিল
মন্ত্রীমশাই যেটি প্রকাশ্যে বলতে পারছেন না, সেটি খোলাখুলি বলেছেন বিজেপির-ই বাছাই করা রাষ্ট্রপতি মনোনীত রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত। যাঁকে মোদী সরকারের সেনাপতি অরুণ জেটলির ঘনিষ্ঠ বলেই মনে করা হয়। তিনি আজ সকালেই টুইট করে বলেন, ‘‘সারোগেসি বিলটি নতুন করে পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। যে বাবা-মায়েদের এই সুবিধা থেকে বাদ দেওয়া হল, সেই পরিধিটা অনেকটাই বড়। তাঁদের সুখ থেকে বঞ্চিত করবেন না।’’ গতকাল সুষমাকে যখন সমকামী, সিঙ্গল পেরেন্ট, লিভ-ইন সম্পর্কে থাকা দম্পতিদের বাদ দেওয়া বিশাল অংশের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তখন তাঁর জবাব ছিল, ‘‘যে কোনও দেশ নিজের হিসেবে আইন তৈরি করে। এ দেশের ‘ইথোস’-এর বিরুদ্ধে যেটি, যেটি এখনও আইনি স্বীকৃতি পায়নি, তার ভিত্তিতে কী করে আইন করা যায়?’’
সুষমার এই ভাবনার পিছনে অনেকেই আরএসএসের দর্শনের ছাপ দেখছে। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন উঠছে, সরকার কী করে ঠিক করে দিতে পারে, সন্তানপালনের অধিকার কার আছে? যখন এখনও এ দেশের আইন মোতাবেক সিঙ্গল পেরেন্টরা সন্তান দত্তক নিতে পারেন, তাঁদের সারোগেসির মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দিতে বাধা কেন? সমকামীদের নিয়ে লড়াই করা ‘স্পেস’ সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অঞ্জন জোশী বলেন, ‘‘সমকামীরা সন্তান পালন করতে পারবেন না, এমন ধারণার ভিত্তিতে সরকার কেন একটি বৈষম্যমূলক আইন আনতে চলেছে? সমকামীদের কথা যদি ছেড়েও দেওয়া যায়, এই সরকার সদ্য লোকসভায় রূপান্তরকামীদের নিয়ে বিল পেশ করেছে। এক দিকে সরকার তাঁদের স্বীকৃতি দিচ্ছে, আর অন্য দিকে এমন একটি বিল বানিয়ে তাঁদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে।’’
কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, কারা বাদ পড়ছেন, সেটি মাথায় রেখে এই বিল আনা হয়নি। একটি হিসেবে অনুযায়ী, সারোগেসির মাধ্যমে এ দেশে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ব্যবসা ফুলেফঁপে উঠেছে। এর অপব্যবহার হচ্ছে। যাঁদের সন্তানের বাবা-মা হওয়ার ইচ্ছা রয়েছে, তাঁদের জন্য দত্তক নেওয়ার পথ এখনও খোলা। কিন্তু সারোগেসির নামে কোনও গরিব মহিলাকে অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করার পথ বন্ধ করা হচ্ছে। সেই মহিলার স্বাস্থ্যের বিষয়েও সরকার চিন্তিত। সে কারণে সরকার সত্যিকারের নিঃসন্তান দম্পতির স্বার্থই একমাত্র সুরক্ষিত করতে চাইছে। নারীবাদী কর্মী কবিতা কৃষ্ণণের মতে, ‘‘সরকারের ভাবনা ঠিক পথে রয়েছে। কিন্তু নতুন আইন করে পিছনের দরজা দিয়ে বাণিজ্যিক সারোগেসিকে আরও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে না তো?’’