সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
সংবাদ সংগ্রহের কাজে সাংবাদিকদের নিজ নিজ ‘সোর্স’ থাকে। থাকে গোপনীয়তার প্রশ্ন। সুতরাং সাংবাদিকদের ডিজিটাল সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা থাকা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করল সুপ্রিম কোর্ট। মঙ্গলবার বিচারপতি সঞ্জয় কিষেণ কল এবং বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়ার বেঞ্চে এই বিষয়ে একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানি চলছিল। সেখানেই বিচারপতি কল বলেন, ‘‘এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ব্যাপারে অবশ্যই নির্দেশিকা থাকা দরকার। সাংবাদিকদের নিজস্ব ‘সোর্স’ থাকে। গোপনীয়তার অধিকার কিন্তু মৌলিক অধিকার।’’
ফাউন্ডেশন ফর মিডিয়া প্রফেশনালস নামে একটি সংস্থার পক্ষ থেকে এই জনস্বার্থ মামলা করা হয়েছে। সংস্থার তরফে আইনজীবী ছিলেন রাহুল নারায়ণ এবং সিদ্ধার্থ আগরওয়াল। তাঁরা দু’জনেই আবেদন জানান, তদন্তকারী সংস্থাগুলি যাতে ‘ইচ্ছামতো’ সাংবাদিকদের ডিজিটাল সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করতে না পারে, তার জন্য রক্ষাকবচ দেওয়া হোক। আগরওয়াল সওয়াল করেন, ‘‘এই মুহূর্তে দেশের শতাধিক সাংবাদিকের ডিজিটাল সামগ্রী বাজেয়াপ্ত হয়ে রয়েছে। কখন কী বাজেয়াপ্ত করা যায়, বাজেয়াপ্ত ডিজিটাল সামগ্রীর কোন তথ্যভান্ডারে হাত দেওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে তথ্যসুরক্ষার কী হবে, এ সব নিয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা প্রয়োজন।’’ বিচারপতিরাও তাঁদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে বিষয়টির সঙ্গে একমত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে তদন্তকারীদের এক্তিয়ার এতে খর্ব হতে পারে বলে যুক্তি দেওয়া হলে আদালত এ-ও বলেছে, ‘‘রাষ্ট্র শুধু তদন্তকারী সংস্থা দ্বারা চালিত হতে পারে না।’’
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপের অভিযোগ বারবারই উঠছে দেশ জুড়ে। সংবাদমাধ্যমের অফিসে তদন্তকারী সংস্থার অভিযান, সাংবাদিকদের গ্রেফতারি এবং ‘তদন্তের স্বার্থে’ সাংবাদিকদের মোবাইল ফোন-ল্যাপটপ-সহ যাবতীয় ডিজিটাল সামগ্রীর ঢালাও বাজেয়াপ্তকরণের ঘটনা আর বিরল নয়। এই আবহেই সাংবাদিকদের স্বাধীনতা এবং রক্ষাকবচের আবেদন নিয়ে মামলা উঠেছে শীর্ষ আদালতে। এর আগে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ১৬টি সংস্থা প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়কে চিঠি লিখে সংবাদমাধ্যমের প্রতি তদন্তকারী সংস্থাগুলির ‘দমনমূলক’ কাজকর্মের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতেরহস্তক্ষেপ চেয়েছিল।
কেন্দ্রের তরফে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল এসভি রাজু তাঁর সওয়ালে পাল্টা বলেন, যে কোনও ব্যক্তিই তাঁর ডিজিটাল তথ্যের ব্যাক আপ রাখতে পারেন। কিন্ত ব্যাক আপ রাখার সংস্থান রয়েছে বলেই নির্দিষ্ট নির্দেশিকা আর প্রয়োজন নেই, এ কথা মানেনি সুপ্রিম কোর্ট। বিপক্ষের আইনজীবী বলেন যে, ডিজিটাল সামগ্রী যখন তদন্তকারীদের হাতে চলে যায়, তখন ব্যাক আপ নেওয়ার সুযোগ থাকে না। তা ছাড়া তথ্যের নাগালের পাশাপাশি তথ্যের সুরক্ষার বিষয়টিও শুনানিতে উঠেছে। বিচারপতি কল বলেছেন, তদন্তের স্বার্থে সঞ্চিত তথ্যভান্ডারের ঠিক কোন অংশটুকু প্রয়োজন, তা তদন্তকারীদের দেখা দরকার এবং প্রাপ্ত তথ্য যাতে কোনও ভাবেই তৃতীয় কোনও পক্ষের কাছে না যায়, তা-ও নিশ্চিত করা দরকার। উত্তরে রাজু বলেন, তদন্তকারীদের এ ভাবে রাশ টেনে ধরা ঠিক নয়। বিচারপতি তার জবাবে দৃঢ় ভাবে বলেন, ‘‘এটা মানা যায় না। এটা খুবই বিপজ্জনক। স্বচ্ছতর নির্দেশিকা প্রয়োজন। আপনার না পারলে আমরা তৈরি করে দিতে পারি। কিন্তু উচিত কাজ হবে, আপনাদেরই সেটা তৈরি করা। রাষ্ট্র শুধু তদন্তকারী সংস্থা দ্বারা চালিত হতে পারে না।’
রাজুর বক্তব্য ছিল, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার অধিকার আছে ঠিকই, কিন্তু সংবাদমাধ্যম আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আগরওয়াল তখন দাবি করেন, আইনটাই স্পষ্ট করে সামনে রাখতে বলা হচ্ছে। বিচারপতিরাও বলেন, আইনের ভিত্তিতেই নির্দিষ্ট নির্দেশিকার প্রয়োজন আছে। রাজু বলেন, এর মধ্যে অনেক আইনি জটিলতা আছে। শুনানি মুলতুবি রাখা হোক। সরকার পক্ষ যাতে সময় নিয়ে এই নির্দেশিকার বিষয়টি স্থির করতে পারে, তার জন্য ৬ ডিসেম্বর পরবর্তী শুনানি হবে বলে জানান বিচারপতিরা।