ব্রাহ্মরা কি হিন্দু, জানাতে নির্দেশ কেন্দ্রকে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা সত্যজিৎ রায় কি ধর্মীয় সংখ্যালঘু— বিচার করার ভার পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে। ব্রাহ্ম মতাবলম্বীরা একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নাকি একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র ধর্ম, সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে আজ এই নিয়ে জোর সওয়াল চলে।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪২
Share:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা সত্যজিৎ রায় কি ধর্মীয় সংখ্যালঘু— বিচার করার ভার পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে।

Advertisement

ব্রাহ্ম মতাবলম্বীরা একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নাকি একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র ধর্ম, সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে আজ এই নিয়ে জোর সওয়াল চলে। ব্রাহ্ম সমাজ এডুকেশন সোসাইটির পক্ষ থেকে সেখানে দাবি করা হয়, ব্রাহ্মধর্ম একটি স্বতন্ত্র ধর্ম। সুপ্রিম কোর্ট তার উত্তরে জানায়— আইন অনুযায়ী কারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু আর কারা নয়, সেটা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার। কাজেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত হতে গেলে সরকারের কাছেই দরবার করতে হবে।

অতএব? ১৮২৮-এর ২০ অগস্ট রামমোহন রায়ের হাত ধরে যে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী কালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসুদের নেতৃত্বে যে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচার এবং গোষ্ঠীভেদ— এত যুগ পরে নতুন করে তার ধর্মীয় মর্যাদার প্রশ্নটি আতসকাচের তলায় এল।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে বাহ্ম সমাজকে সরকারের কাছে পৃথক ধর্মের মর্যাদা চেয়ে আবেদন জানাতে হবে এবং মোদী সরকারকে এক বছরের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পৃথক ধর্মের মর্যাদা পেলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে স্বীকৃত হবেন ব্রাহ্মরা। কলকাতায় ব্রাহ্ম সমাজের পরিচালনাধীন যে আটটি কলেজ রয়েছে, সেগুলিও সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা পাবে।

কিন্তু এত দিন পরে কেন এই বিতর্ক মাথা চাড়া দিল? কারণ ব্রাহ্ম সমাজ এডুকেশন সোসাইটি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে কলেজ সার্ভিস কমিশনের বদলে তারা যেন নিজেরাই নিজেদের পরিচালনাধীন কলেজগুলিতে শিক্ষক নিয়োগের অধিকার পায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই আবেদনের বিরোধিতা করে। তাদের যুক্তি, উত্তরে রামমোহন রায় সরণির সিটি কলেজ, সূর্য সেন স্ট্রিটে সিটি কলেজ অব কমার্স এবং দক্ষিণে গড়িয়াহাট রোডে সাউথ সিটি কলেজ ভবনে সোসাইটির পরিচালনাধীন আটটি কলেজ রয়েছে। এই কলেজগুলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত এবং রাজ্য সরকারের অনুদান-নির্ভর। সুতরাং শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের অন্য কলেজের মতোই কলেজ সার্ভিস কমিশনের নিয়ম মেনে চলতে হবে বলে রাজ্য সরকার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি।

গত বারো বছর ধরে টানাপড়েনের পর আজ মামলাটি ওঠে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে। প্রধান বিচারপতি প্রথমেই প্রশ্ন তোলেন, ব্রাহ্মরা কি একটি পৃথক ধর্ম মেনে চলেন, না কি তাঁরা শুধুই একটি পৃথক ধর্মীয় সম্প্রদায়? ব্রাহ্ম মত যদি আলাদা ধর্ম হয়, তা হলে ব্রাহ্মরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিবেচিত হবেন। তখন তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের সমতুল সুবিধা পাবে।

সোসাইটির তরফে আইনজীবী অনুপ বসু যুক্তি দেন, হিন্দু ধর্ম থেকে উৎপত্তি হলেও ব্রাহ্ম মত একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র ধর্ম। নিছক ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়। তার পরেই প্রধান বিচারপতি বলেন, আইন অনুযায়ী কারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার। আদালতের পক্ষে ইতিহাস ঘেঁটে ঠিক করা সম্ভব নয় কোনটি স্বতন্ত্র ধর্ম, আর কোনটি নয়। কেন্দ্রের তরফে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল পিঙ্কি আনন্দ এর পরে আদালতে জানান, এই বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমিশন রয়েছে। তারাই এ বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ জানাবে। এর পরেই বিচারপতিরা ছয় সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্রের সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রকের কাছে পৃথক ধর্মের স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন জানাতে বলেন ব্রাহ্মদের।

ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য সংক্রান্ত বিতর্কে সুপ্রিম কোর্ট নিজে ঢুকতে না চাইলেও আদালতকক্ষে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তাত্ত্বিক বিতর্ক কিছু কম হয়নি। ব্রাহ্ম সমাজের তরফে বলা হয়েছে, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ একটি একেশ্বরবাদী সংগঠন। একটি স্বতন্ত্র ধর্মমত। উল্টো দিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ইতিহাস তুলে ধরে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু ধর্মের থেকে আলাদা না হয়েই ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারের কথা বলেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা লেখে, রাজা রামমোহন রায় কখনওই বলেননি যে ব্রাহ্ম সমাজ হিন্দু সমাজের থেকে আলাদা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী পীযূষকান্তি রায় আদালতে জানান, আলোচ্য কলেজগুলির সিংহভাগ ছাত্র ব্রাহ্ম নন। নিজেদের মতো শিক্ষক নিয়োগ করলে ওই কলেজগুলিতে শিক্ষার মান পড়ে যাতে পারে।

রাজ্যের তরফে আজ আদালতে জানানো হয়, সুপ্রিম কোর্টের ৩২ বছরের পুরনো একটি নির্দেশে ওই আটটি কলেজ এমনিতেই বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। কলেজ সার্ভিস কমিশন একটি শূন্যপদের জন্য তিন জনের নাম পাঠায়। তার মধ্যে এক জনকে বেছে নিতে পারে এই কলেজগুলি। অন্য কলেজের কিন্তু এই অধিকার নেই। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, ব্রাহ্ম ধর্মের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে সিদ্ধান্ত না-হওয়া পর্যন্ত ১৯৮৪ সালের ওই নির্দেশ বহাল থাকবে। তবে একটি শর্ত বেঁধে দিয়েছে আদালত। ছয় সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্রের কাছে আবেদন না জানালে এই বাড়তি সুবিধা বহাল থাকবে না। শুনানির পর আদালত থেকে বেরিয়ে ব্রাহ্ম সমাজ এডুকেশন সোসাইটির অন্যতম সম্পাদক কুমকুম বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, তাঁরা ছয় সপ্তাহের মধ্যেই আবেদন জানাবেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা আনন্দিত। কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানানোর আগে গোটা দেশে কত জন ব্রাহ্ম রয়েছেন, তারও গণনা দরকার। আপাতত কলেজগুলি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না, এটাই ভাল খবর।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement