বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার হাত থেকে পালানোর পথ নেই। ছবি: এএফপি।
গোড়ায় এই পথে হেঁটেছিল ব্রিটেন। লকডাউন না-করে উল্টে জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার (হার্ড ইমিউনিটি) নীতি নিয়েছিল বরিস জনসনের দেশ। যথেষ্ট স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অভাবে সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। কিন্তু ভারত সরকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে যে ভাবে লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা দেখে বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, এতে সংক্রমণ সাময়িক ভাবে বাড়লেও ধীরে ধীরে দেশের জনগোষ্ঠীর কোভিড-১৯ প্রতিরোধের ক্ষমতা গড়ে উঠবে। তাঁদের মতে, প্রতিষেধক কবে মিলবে, স্পষ্ট নয়। আজ নয় কাল, মানুষকে বেরোতেই হবে। তাই পোলিয়ো বা যক্ষ্মার মতো তাঁদের শরীরে করোনা প্রতিরোধের ক্ষমতাও গড়ে ওঠা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার হাত থেকে পালানোর পথ নেই। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি (আইআইসিবি)-র বিজ্ঞানী দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এই ভাইরাস এইচআইভি-র মতো নয় যে, কিছু সুরক্ষাবিধি পালন করলেই ঠেকানো যাবে। ভাইরাসটি হাঁচি-কাশি বা ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই একে আটকানো কঠিন।’’ ইনস্টিটিউট অব জেনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি-র প্রাক্তন প্রতিষ্ঠাতা-ডিরেক্টর সমীর কে ব্রহ্মচারীর মতে, ‘‘করোনা খুব শক্তিশালী ভাইরাস। এক জন সংক্রমিত এক মাসে ৪ হাজার লোককে সংক্রমিত করতে পারেন। এ দিকে, প্রতিষেধক না-আসা পর্যন্ত লকডাউন চালানো অসম্ভব। তাই ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে জনগোষ্ঠীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ যখন ভাইরাসটিকে প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জন করবেন, তখন সেটি দুর্বল হয়ে পড়বে।’’
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর বায়োলজিক্যাল সায়েন্স শাখার অধ্যাপক পার্থসারথি রায়ের কথায়, ‘‘দেখা গিয়েছে, যে ভাইরাসের মারণক্ষমতা বেশি, সেগুলির সংক্রমণ ক্ষমতা সাধারণত কম। যেমন ইবোলা। একটি ছোট জায়গায় এর সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। কিন্তু ওই ভাইরাসের মারণক্ষমতা বেশি হওয়ায় হোস্ট (মানবশরীর) মারা যেতেই ভাইরাস নষ্ট হয়ে যায়। বিবর্তনের নিয়ম মেনে কম মারণক্ষমতার ভাইরাস একমাত্র রয়ে যায়। যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা। যা বিভিন্ন সময়ে ঘুরে-ফিরে আসে।’’ কম মারণক্ষমতার করোনাও ভবিষ্যৎ জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠতে চলেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
আরও পড়ুন: তিন গুণ দামে ট্রেনের টিকিট! প্রতিবাদ করায় পরিযায়ী শ্রমিককে মার, অভিযুক্ত বিজেপি নেতা
দীপ্যমান বলছেন, করোনা-আক্রান্তদের প্রায় আশি শতাংশই উপসর্গহীন। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সরকারি হিসেবে ভারতে আক্রান্তের যা সংখ্যা, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মানুষ অজান্তে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকে অজান্তে সুস্থও হয়ে যাচ্ছেন। এঁদের শরীরে করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠছে। এমন মানুষের সংখ্যা বাড়লেই ভাইরাসের প্রকোপ কমবে। দীপ্যমানের মতে, এ দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হলে করোনা নিয়ে ভয় থাকবে না। পার্থসারথির বক্তব্য, ‘‘এঁরাই ভবিষ্যতে সংক্রমিত ও সংক্রমিত নন-- এমন মানুষদের মধ্যে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবেন। ফলে নতুন করে সংক্রমণ ছড়াবে না। পোলিয়ো বা চিকেন পক্সের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন দিয়ে এই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা হয়। স্বাভাবিক ভাবে করতে হলে মানুষকে ভাইরাসের সংস্পর্শে আসতে হবে।’’ বিশেষজ্ঞদের তাই আশ্বাস, আতঙ্কের কিছু নেই। বয়স্ক বা যাঁদের অন্য রোগ রয়েছে, তাঁদের হয়তো হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, কিন্তু অধিকাংশই সুস্থ হয়ে যাবেন।
তবে এ কথা ঠিক, ভারতের মতো জনবহুল ও দুর্বল স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর দেশে গোষ্ঠী-সংক্রমণ সামলানোও মুশকিল। অধিকাংশ মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠাও বেশ সময়সাপেক্ষ। তাই বিশেষজ্ঞেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সংক্রমণ এড়ানোর চেষ্টাটাও চালিয়ে যেতে হবে। আপাতত মাস্ক পরতেই হবে, পারস্পরিক দূরত্ববিধিও মানতে হবে। সমীরবাবুর পরামর্শ, ‘‘বয়স্কদের যদি অন্যান্য রোগের সমস্যা থাকে, সে ক্ষেত্রে তাঁরা যাতে সংক্রমিত না-হন, তা খেয়াল রাখতে হবে। যাঁদের বাড়িতে বয়স্কেরা রয়েছেন, তাঁদের আগামী কয়েক মাস বাড়ি থেকেই কাজ করা ভাল।’’
আরও পড়ুন: এ বছর দেশের আর্থিক বৃদ্ধি হবে ০%, আরও ভয়াবহ পূর্বাভাস মুডিজ-এর
গোষ্ঠী-সংক্রমণই যদি মুক্তির পথ হয়, তা হলে লকডাউনে কী লাভ? সমীরবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘লকডাউন করে সরকার ভাইরাসের শৃঙ্খলকে ভাঙতে চেয়েছে। আগে তিন দিনে হলে এখন ১২ দিনে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে।’’ দীপ্যমানের মতে, হাসপাতালগুলিতে যাতে এক ধাক্কায় রোগীর ভিড় না-হয়, তাই এই সময়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গুছিয়ে নিতে চেয়েছে সরকার। চিকিৎসা-পদ্ধতিও খতিয়ে দেখার সময় মিলেছে। সমীরবাবু জানান, ব্রিটেন স্বাস্থ্য পরিকাঠামো না-সাজিয়েই জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে চাওয়ায় সমস্যা হয়েছিল। সুইডেনের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো আরও উন্নত। তারা শুরু থেকেই এই পথে হেঁটেছে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)