উত্তরকাশীর ভাঙা সুড়ঙ্গে চলছে উদ্ধারকাজ। ছবি: পিটিআই।
ছোটবেলায় একটা গান শুনেছিলাম। ‘চিট্ঠি আয়ি হ্যায়’। তাতে এক জায়গায় ছিল, ‘আ যা, উমর বহত হ্যায় ছোটি, আপনে ঘর মে ভি হ্যায় রোটি’। জানি, আমাদের ঘরেও কষ্ট আর আনন্দ মেশানো ভাত-রুটি আছে। বাড়ির সঙ্গে যখন প্রথম
কথা হল সুড়ঙ্গ থেকে বার হওয়ার পরে, বাবা-মা দু’জনেই বললেন, বাড়ি ফিরে আয়।
কিন্তু আমি যাব না। আমার ইচ্ছে, কাজ চালিয়ে যাব। কেন বলুন তো?
কারণ, বাইরে কাজ করার আনন্দই আলাদা। আমরা একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিলাম। সেই ঝুঁকি তো সর্বত্র থাকতে পারে। ঘরের কাছেও থাকতে পারে। তা হলে?
কারণ, এত দিন ধরে কাজ করতে করতে এখানে আমরা একটা দল হয়ে গিয়েছি। সেই দলেরই কয়েক জন সে দিন বাইরে ছিল, কয়েক জন ভিতরে। যারা আমরা ভিতরে ছিলাম, এক সঙ্গে বেঁধে বেঁধে ছিলাম। যাঁরা, তাঁরা বাইরে ছিলেন, কত ভাবে যে সাহায্য করেছেন, বলে বোঝাতে পারব না। মাঝে একটা বাধার দেওয়াল ছাড়া মনেই হয়নি, কোনও নির্জন জায়গায় একা পড়ে আছি।
তবে এটা ঠিক, শুরুতে খারাপ লাগছিল। প্রথমে তো বুঝতেই পারিনি, আমরা সুড়ঙ্গে আটকে পড়েছি। বাইরে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাই অফিসে খবর দেন। আধিকারিকেরা এসে পাইপের মাধ্যমে কথা শুরু করলে বুঝতে পারি, আটকে পড়েছি আমরা, ৪১ জন। তত ক্ষণে ঘণ্টাখানেক কেটে গিয়েছে। তখন একটু খারাপ লেগেছিল বৈকি। আমার বয়স ২৪ বছর। ১৯ বছরের জয়দেব পরামানিক আমারই মতো পুরশুড়ার ছেলে। প্রায় সারা ক্ষণ একসঙ্গেই ছিলাম আমরা। ঘটনার কিছু ক্ষণের মধ্যেই কাজের জন্য ঢোকানো পাইপের মাধ্যমে অক্সিজেন এবং মুড়ি পাঠনো হয়।আমাদের সাহস জোগাতেবাইরে থাকা স্যরেরা, সহকর্মীরাপাইপ দিয়ে অনবরত যোগাযোগ করেছেন। পরের দিন থেকে বাড়ির খবরও পেতে শুরু করি। আমাদের ‘ভয়েস রেকর্ড’ বাড়িতে পাঠানো হয়। সর্বোপরি, জয়দেবের জামাইবাবু তথা আমাদের সংস্থারই কর্মীসুরজিৎ বেরা বাইরে থাকায় অনেক চিন্তামুক্ত ছিলাম।
প্রথম দু’দিন মাজন ছিল না। তাই দাঁত মাজতে পারিনি। তৃতীয় দিন ৬ ইঞ্চির পাইপ ঢোকানার পরে মাজন, ব্রাশ, সাবান— সব পাঠানো হয়। ভাল খাবার আসতে শুরু করে। সেখানে সূর্যের আলো নেই। পাহাড় থেকে চুঁইয়ে আসা জলে স্নান করলে ঠান্ডা লেগে শরীর খারাপ হতে পারে, এই ভয়ে রোজ স্নান করিনি। তবে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে অসুবিধা হয়নি। ২ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গের ১০০ মিটার অন্তর থাকা পকেট ব্যবহার করতে বলা হয়েছিল। সেখানে গর্ত করে মলত্যাগ, তার পরে মাটি চাপা দিতে হত।
ভিতরে সবাই মিলে গল্পগুজব করে, মোবাইলে গান শুনে, সিনেমা দেখে সময় কেটেছে। খেলার জন্য ব্যাট-বল, তাস পাঠানো হয়েছিল বাইরে থেকে। যখন জানতে পারি, আমাদের উদ্ধারের জন্য শুধু আমাদের সংস্থা নয়, সরকার-সহ গোটা দেশ উন্মুখ হয়ে আছে, তখন সবচেয়ে বেশি সাহস পেয়েছি।
বুধবার জেলা হাসপাতাল থেকে হেলিকপ্টারে হৃষীকেশ এমসে এনে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হল। জীবনে প্রথম হেলিকপ্টারে চড়লাম। সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। বাবা-মাকে বুঝিয়েছি। কাজ ছেড়ে যেতে চাই না আমি।