বাঁধা গৎ ছেড়ে বেরোতে চাইছেন তিনি। সংসদের ভিতরে-বাইরে স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলছে নয়া জমানার! ছক ভাঙতে গিয়ে কিছু বিভ্রাটও আসছে। তবু সিপিএমের নতুন সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বুঝে নিয়েছেন, দলের প্রাসঙ্গিকতার রেখচিত্র আবার উপরে তুলতে গেলে এ ছা়ড়া পথ নেই!
বুঝেছেন বলেই শুধু ‘নেহি চলেগা, নেহি চলেগা’-র রাজনীতি থেকে সিপিএমকে বার করে আনতে চাইছেন ইয়েচুরি। কথায় কথায় সংসদ অচল করে দেওয়ার পথে হাঁটছেন না। তার বদলে নিজের সীমিত শক্তি বুঝেই সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলতে চাইছেন। চাইছেন সব বিরোধীকে একসঙ্গে নিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। ইয়েচুরি দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরে অল্প সময়েই দলের সংসদীয় রণকৌশলে এই পরিবর্তন চোখে পড়ছে অন্যদের।
কিন্তু ‘পরিবর্তনে’র কিছু মূল্যও চোকাতে হচ্ছে নতুন সাধারণ সম্পাদককে! ইয়েচুরি নেতৃত্বে এসেছেন মানেই প্রকাশ কারাটের আমলের সব সিদ্ধান্তই পাল্টে যাবে, এমন ধারণা দানা বেঁধেছে দলের ভিতরে-বাইরে। যার জেরে বিড়ম্বনায় পড়ছেন ইয়েচুরিই। রবিবারই যেমন ইউপিএ-১ সরকার থেকে বামেদের সমর্থন প্রত্যাহারের প্রশ্নে কারাটের থেকে তাঁর সম্পূর্ণ ভিন্ন মত প্রকাশ্যে এসে গোল বেধেছিল সিপিএমে!
কী হয়েছিল এ দিন? সংবাদসংস্থা পিটিআই ইয়েচুরিকে উদ্ধৃত করে জানায়, ‘পরমাণু চুক্তির প্রশ্নে ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার ‘ভুল’ হয়েছিল। মূল্যবৃদ্ধির মতো সাধারণ মানুষের মনের কাছাকাছি কোনও বিষয়ে সমর্থন তুললে ভাল হতো। ইউপিএ সরকার যে ‘আম আদমি’র কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে প্রচারে গেলেই ভাল হতো।’ নতুন সাধারণ সম্পাদকের এমন ‘স্বীকারোক্তি’র কথা প্রচারিত হতেই শোরগোল পড়ে যায় দলে! বিশেষত, বাংলা সিপিএমে। কারণ বঙ্গ ব্রিগেডের বড় অংশই এখনও মনে করে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পরে সেই সময়ে কারাট ইউপিএ-র উপর থেকে সমর্থন তুলে না নিলে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হতো না এবং পশ্চিমবঙ্গে বামেদের পতনের শুরুও হতো না। বস্তুত, এরও আগে সমর্থন প্রত্যাহার আটকাতে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সক্রিয় হতে হয়েছিল জ্যোতি বসুকে। ইয়েচুরিকে এই সময় পাশেই পেয়েছিল আলিমুদ্দিন। কিন্তু দলের আনুষ্ঠানিক অবস্থান খারিজ করে সেই মত প্রকাশ্যে আসা মানে যে বিড়ম্বনা, তা বুঝেই বাংলার নেতারাও এ দিন হকচকিয়ে গিয়েছিলেন! বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘সীতারাম এমন কথা বলতেই পারে না! খোঁজ নিতে হবে!’’
স্বয়ং ইয়েচুরি অবশ্য পরে আনন্দবাজারকে বলেন, সংবাদসংস্থা তাঁর নামে সম্পূর্ণ ভুল উদ্ধৃতি দিচ্ছে! ইয়েচুরির ব্যাখ্যা, ‘‘একটা টিভি সাক্ষাৎকারে আমি বলেছি, পরমাণু চুক্তি ঘিরে কেন সমর্থন তুললাম, সেটা মানুষকে বোঝাতে পারিনি আমরা। কারণ, ওটা ‘পিপল্স ইস্যু’ ছিল না। এটা তো আমাদের দলের ঘোষিত অবস্থান। তার বাইরে কিছু বলিনি!’’ ঘটনা যে, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির ২০০৯ সালের দলিলেও এই কথা লেখা হয়েছে। দলের অন্দরে ইয়েচুরি-পন্থী বলে পরিচিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যেরও মত, ‘‘সমর্থন প্রত্যাহারের সময় তো কোনও দ্বিমত আসেনি!’’ কিন্তু এত কিছুর পরেও এ দিন বিতর্ক বাধল কেন? দলের এক বর্ষীয়ান নেতার যুক্তি, ‘‘আসলে প্রকাশ এবং সীতারামের সম্পূর্ণ দু’রকম ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে রয়েছে নানা মহলে। সীতারাম সম্পাদক হয়েছে মানে ও এটা বলতেই পারে, এই রকম ধরে নিচ্ছেন অনেকে! যেটা হয়তো আদতে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ওর পক্ষে বলা সম্ভবই নয়!’’
পরমাণু-বিভ্রাটের ঘটনা যেমন তাঁর ভাবমূর্তির বিপদ দেখিয়ে দিচ্ছে, তেমনই তাঁর সেই ভাবমূর্তিরই ‘ইতিবাচক’ দিকটা এখন বেশি করে কাজে লাগাতে চাইছেন ইয়েচুরি। এত দিন রাজ্যসভায় সিপিএমের দলনেতা ছিলেন। কিন্তু সংসদীয় দলনেতা ছিলেন না। এখন পুরো ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে এসে যাওয়ায় সংসদীয় দলকেও নিজের মতো করে চালাচ্ছেন তিনি। সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই বলছেন, সাংসদ-সংখ্যা কম হলেও সিপিএমের অস্তিত্ব ফের টের পাওয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে বরাবরই সকলের সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক রাখেন ইয়েচুরি। বিজেপি বা কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে ভেদাভেদ করেন না। এ বার দলের প্রবীণ-নবীন সাংসদদেরও একই নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, সকলের সঙ্গে মিশতে হবে। তৃণমূল কিংবা আরএসএস থেকে উঠে আসা বিজেপি সাংসদও কেউ অস্পৃশ্য নন।
তার ফলও মিলছে হাতেনাতে। সিপিএমের পি রাজীবের মেয়াদ ফুরোলে রাজ্যসভায় সম্মিলিত ভাবে তাঁকে ফেরানোর দাবি উঠছে! আবার ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তরুণ সাংসদ বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার পরে কংগ্রেসের এ কে অ্যান্টনি থেকে বিজেপির তরুণ বিজয় ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর প্রশংসা করছেন। ‘লাল সেলাম’ জানাচ্ছেন জাভেদ আখতার!
এত দিন সিপিএমে কেরল ও বাংলার সাংসদেরা আলাদা আলাদা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতেন। লোকসভাতেও দলনেতা পি করুণাকরণের সঙ্গে উপ-দলনেতা মহম্মদ সেলিমের সমন্বয়ের অভাব ছিল। এই সমন্বয়ের অভাবেই তৃণমূলের সঙ্গে সংসদে বিক্ষোভ দেখাতে রাজি হয়ে গিয়েছিল সিপিএম। পরিস্থিতি সামলাতে আসরে নামতে হয়েছিল বুদ্ধবাবুকে। এখন করুণাকরণ-সেলিম দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হচ্ছেন ইয়েচুরি। করুণাকরণ লোকসভায় সিপিএমের রণকৌশলের কথা বলছেন। সেলিম নিয়মিত পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারকে নিশানা করছেন।
দলের দায়িত্ব পাওয়ার পরেই ইয়েচুরি বলেছিলেন, তাঁর অন্যতম লক্ষ্য সিপিএমের দিকে তরুণদের ফের আকৃষ্ট করা। দলের মধ্যেও তরুণ নেতাদের বাড়তি সুযোগ, বাড়তি দায়িত্ব দিচ্ছেন তিনি। লোকসভায় এম বি রাজেশ, পি কে বিজু, রাজ্যসভায় ঋতব্রতদের মতো ছাত্র বা যুব সংগঠন থেকে উঠে আসা তরুণদের এগিয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, ভুল হলে হোক। কিন্তু চেষ্টা করতে হবে। রাজ্যের সাধারণ মানুষের সমস্যা তুলতে হবে। প্রশ্ন করে তথ্য বের করার চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তিতেই যেমন। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কে রাজ্যসভায় সব দলের নেতা বা উপনেতারাই অংশ নিয়েছিলেন। সকলে ভেবেছিলেন, সিপিএমের হয়ে খোদ ইয়েচুরিই এই বিলে বক্তৃতা করবেন। কিন্তু ইয়েচুরি নিজে না বলে এগিয়ে দেন ঋতব্রতকে!
বিল পাশের পরে রাজ্যসভার লবিতে বিজেপির অনিল মাধব দাভে ইয়েচুরিকে বলেন, ‘‘ঋতব্রতকে আরও বলার সুযোগ দিন।’’ বিজেপির নেতাকে ইয়েচুরি বলেন, তিনি ঠিক সেটাই করছেন। এর পরেই মোক্ষম চালটি দেন ইয়েচুরি! আবাসন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিল যে সিলেক্ট কমিটিতে গিয়েছে, দাভে তার চেয়ারম্যান। সেখানে যাতে সিপিএমের মত গুরুত্ব পায়, তার জন্য শেষ লগ্নে কেরলের বালগোপালের নাম কেটে ঋতব্রতকে কমিটিতে ঢুকিয়ে দেন ইয়েচুরি!
রাজ্যসভায় এত দিন থাকলেও কারাট-জমানায় ইয়েচুরিকে সংসদীয় দলনেতার পদ দেওয়া হয়নি। লোকসভায় কোনও কিছুর বিরোধিতা করতে হলে প্রথম ইউপিএ-র আমলেও সভা ভণ্ডুলের পথেই হেঁটেছে সিপিএম। তার পরে দ্বিতীয় ইউপিএ এবং মোদী জমানায় সাংসদ-সংখ্যা কমে আসায় সিপিএমের অস্তিত্বই সঙ্কটে পড়েছিল। এখন কৌশল বদলে ফের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার লড়াইয়ে নেমেছে ইয়েচুরির সিপিএম!