চিনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্বকে যে ভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সঙ্গে একাসনে বসিয়েছেন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী, তাতেই বিতর্ক ছড়িয়েছে। —ফাইল চিত্র।
উত্তরে সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা। দক্ষিণে প্রবল রাজনৈতিক অশান্তি। দুই সমস্যাকে প্রায় এক গোত্রে ফেলে দিলেন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন কুমার চামলিং। বললেন, ‘‘চিন এবং বাংলার মাঝে স্যান্ডউইচ হওয়ার জন্য সিকিমের মানুষ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হননি।’’ সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীর এই ধরনের মন্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরে বিতর্ক ছড়িয়েছে। পবন চামলিং-এর মন্তব্যকে অনেকেই দায়িত্বজ্ঞানহীন বলেও মনে করছেন।
সিকিমের নামচিতে বুধবার এক সরকারি অনুষ্ঠানে পবন চামলিং বিতর্কিত কথাগুলি বলেছেন। পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিঙে যে অশান্তি দশকের পর দশক ধরে চলছে, তাতে সিকিমের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে বলে চামলিং-এর দাবি। দার্জিংলিঙে মাঝেমধ্যেই অবরোধ এবং অচলাবস্থার জেরে গত ৩০ বছরে সিকিম ৬০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। এই ক্ষতি রুখতে এ বার সিকিমের সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করবে বলে চামলিং জানিয়েছেন।
১৯৭৫ সালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সিকিম। দু’টি জাতীয় সড়কের মাধ্যমে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে যুক্ত এই পাহাড়ি রাজ্য। কিন্তু দু’টি রাস্তাই উত্তরবঙ্গের পাহাড় হয়ে সিকিমে পৌঁছেছে। তাই পাহাড়ে অশান্তি শুরু হলেই দেশের বাকি অংশের সিকিমের যোগাযোগ সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ‘‘নাথু লা-য় যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। নীচের দিকেও (শিলিগুড়ি) আমাদের কোনও নিরাপত্তা নেই। তারা বলছে, সিকিমে তারা পেট্রল এবং খাদ্যশস্য ঢুকতে দেবে না। আমাদের লোকজনকে সেখানে হেনস্থা করা হচ্ছে। আমাদের মালপত্র থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’’ মুখ্যমন্ত্রী চামলিং বুধবার এ ভাবেই উষ্মা প্রকাশ করেন।
নাথু লা— ডোকলামে ভারত এবং চিনের বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান করতে শুরু করার পর এই গিরিপথ দিয়ে ভারত-চিন সংযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নাথু লায় যে কোনও সময় যুদ্ধ শুরু হতে পারে বলে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ছবি: এএফপি।
পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে বিমল গুরুঙ্গরা যে আন্দোলন শুরু করেছেন, চামলিং ইতিমধ্যেই সেই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। বাংলা ভেঙে পৃথক গোর্খাল্যান্ড তৈরির দাবির পক্ষে সওয়াল করে কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠিও লিখেছেন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী। স্বাভাবিক ভাবেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার চামলিং-এর তীব্র নিন্দা করেছে। শিলিগুড়ির বাঙালি ভাবাবেগও সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। ফলে সমতলে এসে মাঝেমধ্যে সিকিমের মানুষকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ। চামলিং-এর মতে, চিন সীমান্তবর্তী রাজ্য সিকিমের মানুষ ভারতীয় সীমান্তে ‘বিনা পারিশ্রমিকের সৈনিক’ হিসেবে কাজ করছে। সিকিম ভারতের অন্যতম বড় জলাধার বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। বাংলার অনেক নদী-নালা সিকিম থেকে যাওয়া জলেই পুষ্ট বলে তাঁর দাবি। চামলিং-এর অনুযোগ, ‘‘আমাদের এত অবদান সত্ত্বেও আমাদের রাস্তা আটকে দেওয়া হচ্ছে।’’
আরও পড়ুন: ভারত না পিছোলে ‘স্বাধীন সিকিম’এ উস্কানির হুমকিও দিচ্ছে চিন
চামলিং বলেছেন, ‘‘১০ নম্বর জাতীয় সড়ক আমাদের জীবনরেখা। কিন্তু গত ৩০ বছর ধরে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের জন্য ওই জাতীয় সড়কই আমাদের দুর্বলতা হয়ে উঠেছে।’’ এই অশান্তির হাত থেকে সিকিমকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই পৃথক গোর্খাল্যান্ড তৈরি হওয়া জরুরি। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী এমনই ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন। কিন্তু তার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে যে ভাবে তিনি ভারত-চিন দ্বন্দ্বের সমগোত্রীয় পর্যায়ে ফেলে দিয়েছেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাতেই বিস্মিত। চিন এবং বাংলার মাঝে সিকিম স্যান্ডউইচ হয়ে যাচ্ছে বলে যে মন্তব্য চামলিং করেছেন, তাকে অসংবেদনশীল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সিকিম যেমন ভারতের অঙ্গরাজ্য, পশ্চিমবঙ্গও তেমনই। দুই রাজ্যের মধ্যে যদি কোনও সমস্যা থেকেও থাকে, তা হলেও সেই সমস্যাকে কি ভারত-চিন দ্বন্দ্বের সঙ্গে এক পংক্তিতে ফেলে দেওয়া যায়? প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে।