শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদী। বুধবার সংসদ ভবনে প্রেম সিংহের তোলা ছবি।
মুখে অবিরাম লেগে থাকা হাসিটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, গোটা রাতের মহড়ার ফসল।
তা না হলে নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায় বিস্ফোরক রদবদলের পর সবার নজর যাঁর দিকে, যাঁর ডানা ছাঁটা গেল বলে এত জল্পনা, তিনি এতটা অবিচল থাকেন কী করে!
গত কাল রাতেই মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক থেকে চাকরি গিয়েছে স্মৃতি ইরানির। স্বরাষ্ট্র, অর্থ, বিদেশ আর প্রতিরক্ষা— কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চার মন্ত্রকের পরেই যে মন্ত্রকের উপরে সবার নজর থাকে সেটা হল মানবসম্পদ উন্নয়ন। বিজেপি আমলে এই দফতরের গুরুত্ব আরও বেশি। কারণ সঙ্ঘ পরিবারের নীতি-আদর্শ দেশ জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম হাতিয়ারই হল এই মন্ত্রক। তাই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক সত্ত্বেও ওই পদে নিজের ঘনিষ্ঠ স্মৃতিকে বসিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী।
এহেন স্মৃতিকে কেন সরানো হল বস্ত্র মন্ত্রকে, তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। কিন্তু রদবদল ঘোষণার পর থেকেই তিনি ঘরবন্দি। বাড়ির সামনে সকাল থেকে সংবাদমাধ্যমের ভিড় সত্ত্বেও তাঁর দেখা নেই। ছবিটা পাল্টাল নতুন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর আসার পরে। খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলে প্রকাশ চলে যেতেই সক্রিয় হলেন স্মৃতি। টুইটারে নিজের ছবি পাল্টালেন। আপলোড করলেন তুলনামূলক ভাবে কম বয়সের একটা ছবি। নিজের পরিচয় লিখলেন: কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী। একে একে ধন্যবাদ জানালেন প্রধানমন্ত্রী, প্রকাশ জাভড়েকর এবং আগের মন্ত্রকের কর্মীদের। তার পর ছুটলেন নতুন মন্ত্রকের ভার নিতে।
আর সেখানেই মুখোমুখি হলেন সাংবাদিকদের। আগাগোড়া মুখে ঝুলে রইল মিষ্টি হাসি। আপনাকে নিয়ে এত বিতর্কের কারণেই কি মন্ত্রক বদল হল? উত্তরপ্রদেশের ভোটে দলের মুখ করার জন্যই কি আপনাকে অপেক্ষাকৃত লঘু মন্ত্রক দেওয়া হল? প্রশ্নবাণের মুখে হাস্যমুখে স্মৃতির জবাব, ‘‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে, লোগো কা কাম হ্যায় কহনা। কৃষির পর বস্ত্র মন্ত্রকই সবথেকে বেশি রোজগার দেয়, আর প্রধানমন্ত্রী সেই দায়িত্বই আমাকে দিয়েছেন। আর গত দু’বছরের আলোচনার পর যে শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছে, আমি খুশি নতুন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর সেই নীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’’
অর্থাৎ, মন্ত্রী বদলাল, লক্ষ্য বদলাল না।
স্মৃতির বিরুদ্ধে বিরোধীদের মূল অভিযোগই ছিল, সঙ্ঘ পরিবারের নির্দেশে শিক্ষার গৈরিকীকরণ করছেন তিনি। কংগ্রেস নেতা মণীশ তিওয়ারি আজ বলেন, ‘‘যে গতিতে শিক্ষার গৈরিকীকরণ করার কথা ভেবেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও সঙ্ঘ নেতৃত্ব, সেটি তাঁকে দিয়ে হচ্ছে না বলেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে স্মৃতি ইরানিকে। তাই নতুন মন্ত্রীকে নিয়ে আসা হয়েছে।’’
বিজেপি শীর্ষ সূত্র কিন্তু বলছে, নীতির দিকে থেকে স্মৃতির কাজ ঘিরে কোনও অসন্তোষ নেই দলে বা সঙ্ঘের অন্দরে। আপত্তি কাজের ধরন নিয়েই। এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘সঙ্ঘ স্মৃতির প্রতি রুষ্ট, এই ধারণার কোনও ভিত্তিই নেই। বরং সঙ্ঘ নেতাদের প্রিয়পাত্রীই ছিলেন তিনি। সঙ্ঘের কথায় স্কুল-কলেজে সংস্কৃত পড়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন নিয়োগ— সবই করেছিলেন তিনি। কিন্তু বড্ড সশব্দে।’’ ওই নেতার মতে, স্মৃতির কাজের ধরনে এক দিকে যেমন অহেতুক বিতর্ক তৈরি হচ্ছিল তেমনই ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল সরকারের ভাবমূর্তি। বিদেশের পত্র-পত্রিকা স্মৃতিকে ‘বিতর্ক রানি’ অ্যাখ্যা দিতে শুরু করে। স্মৃতির ঔদ্ধত্যও তাঁর শত্রু বাড়াচ্ছিল। সঙ্ঘের এক নেতা আজ বলেন, ‘‘আরএসএসে আমরা শিখেছি, সব কাজই নিঃশব্দে করতে। স্মৃতি ইরানির সমস্যা হল, তিনি অনেক বেশি আওয়াজ করছিলেন। বাস্তবে কাজ যা হচ্ছিল, তার থেকে বেশি শব্দ হচ্ছিল।’’
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে যায় যে স্মৃতিকে সরানো ছাড়া আর পথ ছিল না প্রধানমন্ত্রীর সামনে। কারণ, সঙ্ঘ নেতৃত্ব মোদী-অমিত শাহকে স্পষ্টই বলে দিয়েছিলেন, কোনও ব্যক্তিবিশেষ তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিষয়টি হল, তাঁদের আদর্শ রূপায়ণের জন্য কে ভাল ভাবে কাজ করতে পারছেন। আর এই সূত্রেই উঠে আসে প্রকাশ জাভড়েকরের নাম। মহারাষ্ট্রের এই নেতা আরএসএসের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। প্রকাশের বাবা কেশবকৃষ্ণ জাভড়েকর ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। দামোদর সাভারকরের কাছের লোক, তথা হিন্দু মহাসভার নেতা। প্রকাশ নিজেও ছাত্র জীবন থেকে এবিভিপির সঙ্গে যুক্ত। জরুরি অবস্থার সময় কারাবাসও করেছেন। বিজেপির একটি সূত্র বলছে, স্মৃতিকে মানবসম্পদ মন্ত্রক থেকে সরানোর বিষয়টি নিয়ে মোদী-অমিতের সঙ্গে আলোচনার সময় সঙ্ঘ নেতারা স্পষ্টই জানিয়ে দেন যে, বিকল্প হিসেবে প্রকাশ ছাড়া অন্য কাউকে মানবেন না তাঁরা।
কঠিন পরিস্থিতি চুপচাপ সামলানোর ব্যাপারে প্রকাশের সুনাম রয়েছে বিজেপির অন্দরে। অনেক বড় বিতর্কও হাসিমুখে সুকৌশলে এড়িয়ে যেতে পারেন তিনি। সঙ্ঘ নেতাদের আশা, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁদের এজেন্ডা এ বার ঢাকঢোল না পিটিয়েই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন জাভড়েকর। সেই ইঙ্গিত আজই দিয়েছেন নতুন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী। আনুষ্ঠানিক ভাবে মন্ত্রকের দায়িত্ব এখনও নেননি। তার আগেই বলেছেন, স্মৃতি ইরানির করা ‘ভাল পদক্ষেপ’গুলি তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সেই সঙ্গে পরামর্শ নেবেন বাজপেয়ী জমানার মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী মুরলীমনোহর জোশীর। শিক্ষা নিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের যে আদর্শ, সরকারি কর্মসূচির মাধ্যমে তার রূপায়ণের প্রথম কারিগরই হলেন জোশী। তাঁর হাত ধরেই শিক্ষায় গৈরিকীকরণের সূত্রপাত। জোশী সঙ্ঘ পরিবারেরও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। প্রকাশ যে সেই উত্তরাধিকার
মেনেই চলবেন, তার ইঙ্গিত প্রথম দিনই দিয়ে রেখেছেন।
যদিও স্মৃতি জমানায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-আন্দোলন নিয়ে বিতর্ককে সামাল দিতে জাভড়েকর বলেছেন, তিনি ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন। ফলে সকলের সঙ্গে আলোচনা করবেন, যাতে কোনও আন্দোলনের অবকাশ না-থাকে। তাঁর কথায়, ‘‘শিক্ষা দলগত রাজনীতির বিষয় নয়।’’
সঙ্ঘ সূত্র অবশ্য বলছে, এনসিআরটি বইয়ের পর্যালোচনা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির পুনর্গঠন, শিক্ষায় মাতৃভাষা প্রয়োগের মতো অনেকগুলি বিষয় এখনও বকেয়া রয়েছে। নতুন শিক্ষানীতিতেও এর অনেকগুলির প্রভাব রয়েছে। নতুন শিক্ষামন্ত্রীর হাত দিয়ে এই বিষয়গুলির রূপায়ণ হবে বলেই তাদের আশা।
তবে সশব্দে নয়, নিঃশব্দে!